ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

জনসেবার গুরুত্ব ও আমাদের দায়িত্ব 

২০২৫ জুন ২৩ ১৭:২৬:২৩
জনসেবার গুরুত্ব ও আমাদের দায়িত্ব 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আজ দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক জনসেবা দিবস ২০২৫। সেবা প্রদান ও সেবা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করে তোলার লক্ষে প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয়। সাধারণত একটা দেশের সার্বিক উন্নয়ন অনেকটাই নির্ভর করে সেবা গ্রহীতা ও সেবা গ্রহণকারীর দেশপ্রেম ও সচেতনতার ওপর। সেবাদানের ক্ষেত্রে একজন মানুষ কতোটুকু আন্তরিক ছিলেন এর নিরিখেই তার মূল্যায়ন হবে। আর এটা বলার প্রয়োজন নেই যে, সেবাদান নিশ্চিত করার জন্য বর্তমান সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ব্যাপক প্রণোদনা প্রদান করছে। তাই সেবা প্রদানে সকলকে সততা, সচেতনতা ও মানবিকতা দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের এখানে সেবা গ্রহীতারা কাংখিত সেবা পাচ্ছে না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক জনসেবা দিবস পালনের গুরুত্ব অনেক বেশি। আর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২০০২ সালের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৩ জুন আন্তর্জাতিক জনসেবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে খুব সম্ভবত ২০১০ সাল হতে এ দিবসটি সরকারীভাবে পালিত হয়ে আসছে। তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগসুবিধা ইউনিয়ন এমনকি প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে চলে যাওয়ায় সরকারী সেবা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে কাঙ্খিত সেবা সহজে ও অতি অল্প সময়ের মধ্যে নিতে পারছে। জনগণের জন্য প্রশাসন বা জনমূখী প্রশাসন নতুন কোন টার্ম নয়, আমাদের সংবিধানে একথা শুরু থেকেই সন্নিবেশিত রয়েছে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১(২) এ বলা হয়েছে" সবসময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রতিটি কর্মচারীর দায়িত্ব"। সংবিধানে "জনগনই সকল ক্ষমতার উৎস" বলা হয়েছে। সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে। মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন প্রণয়নেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধান সম্পূর্ণরুপে জনগণের জন্য জনগনের কল্যাণে প্রণীত সংবিধান। এমনকি বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত আইন, বিধি, সার্কুলার, প্রজ্ঞাপন, অর্ডিন্যান্স জারী হয়েছে বা হচ্ছে সবগুলোর প্রারম্ভিকায় "জনস্বার্থে ইহা জারী/প্রণয়ন করা হইল" লেখা থাকে।আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার সাথে সঙ্গতি রেখে সরকার কাজ করছে। সরকার বলতে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত। এমনকি রাষ্ট্রপতিকে দেশের জনগনের প্রধান খাদেম হিসেবে গণ্য করা যায়। জনগনের সেবা নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনে নতুন নতুন মন্ত্রণালয়, বিভাগ গড়ে তুলছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কোন না কোনভাবে জনগনের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট সেবা নিয়ে কাজ করছে।

মন্ত্রণালয় থেকে বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি গ্রাম পর্যায়ে জনসেবা ইউনিট চলে গেছে। সত্যিকার অর্থে সেবা এখন জনগনের দোরগোড়ায়। আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারি সুযোগসুবিধাও অনেক বেড়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় শতাধিক কর্মসূচি নেওয়া আছে যা সারা বিশ্বে অনন্য। প্রতিবছর যে পরিমাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে তার যথাযথ প্রয়োগ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবকাঠামোগত ও জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব। প্রতিটি উপজেলায় যে পরিমাণ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, শিক্ষা ভাতা, পঙ্গুত্ব ভাতা দেয়া হয় সঠিকভাবে বন্টণ হলে অসহায় জনগোষ্ঠীর কেউই বাদ পড়ার কথা নয়।আর সেবার বিষয়ে সাধারণ জনগনকে জিজ্ঞাসা করলে আসল তথ্য পাওয়া যায়। আর আমরাওতো এ সমাজের ভেতরেই বসবাস করছি।

আত্মীয় বন্ধু বান্ধব সেবা গ্রহণ করতে এসে নানা হয়রাণীর অভিযোগ প্রায়শই করেন। সংশ্লিষ্ট অফিসে ফোন করে সমাধানের চেষ্টা করি, অনেক সময় আবার ব্যর্থও হই। কেউ যদি সহজে শুনতে না চায়, কী-ই বা করার থাকে? বলতে পারেন, নাগরিক সুরক্ষার অনেক মাধ্যম আছে, তার মাধ্যমে প্রতিকার নেন? বিষয়টি অনেকদূর সত্য হলেও তাতে বিড়ম্বনাও অনেক। অভিযোগকারী অভিযোগ দায়ের করলে তার জন্য কোন সুরক্ষা রাখা হয়নি। অর্থাৎ, কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার যাওয়া আসা, তাকে ব্যক্তিগতভাবে শুনানীতে হাজির হওয়া এরুপ বিড়ম্বনা পরিহার করতে 'ভাগ দিয়ে যদি মুক্তি পাওয়া যায় বরং তাই ভাল' কিংবা ' গোপনে চড়থাপড় খেয়ে নিলাম, কেউ জানলো না, কাউকে জানানোরও আবশ্যক নাই'- এই তত্ত্বের উপর সন্তুষ্ট হয়ে অনেকে পথ চলেন। কেউ কেউ আবার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ উদ্ধার করেন। এক্ষেত্রেও পেছনে শক্ত সাপোর্ট না থাকলে বিপদ আছে।

সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তদবির কিংবা কর্মচারীকে উৎকোচ প্রদান করা এখনো একটি সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। প্রচলিত আছে, অফিসে টাকা বা তদবির ছাড়া কোন কাজ হয়না। এ বিষয়টি হয়ত অনেক ক্ষেত্রে সঠিক নাও হতে পারে। এটা নির্ভর করে কর্মচারীর ব্যক্তিগত সততা ও কাজের প্রতি একাগ্রতা, দায়বদ্ধতা ও নিষ্ঠার উপর। তদবির বা খুটির জোরে সেবা পাওয়া, এটা সেবার কোন মানদণ্ড হতে পারেনা। যখন কোন সেবাপ্রার্থী তার প্রত্যাশিত সেবা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করেন এবং কর্তৃপক্ষ আবেদনটি যাচাই করে যথার্থ হলে কাঙ্খিত সেবা আইনানুযায়ী অনায়াসে সেবা প্রার্থীকে প্রদান করেন তখনই কেবল আমরা বলতে পারি, সেবা নিশ্চিত হয়েছে। এতে টাইম-কস্ট- ভিজিট (টিসিভি) অবশ্যই বিবেচ্য বিষয় হবে। সেবা দাতার কাছে সেবাগ্রহীতার যত কম ভিজিট হবে, সময় ব্যয় কম হবে এবং মিনিমাম কস্টে সার্ভিস ডেলিভারি পাবে, তার আলোকেই কেবল সেবার মানদণ্ড নিধারণ হবে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কিংবা ভুক্তভোগীদের বক্তব্য বলতে গেলে লেখার কলেবর শুধু বেড়েই চলবে। সেদিকে আর গেলাম না। আসলে কে কী সেবা দিচ্ছি বা নিচ্ছি তা আমজনতার মুখ থেকেই আমরা সর্বত্র শুনতে পাই, যা একজন সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে ভাল লাগার কোন বিষয় নয়। আমাদের মধ্যে যদি বিন্দু পরিমাণ বিবেকবোধ থাকে, আমরা যদি মনে করি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে সুনির্দিষ্ট সেবা প্রদান করাই আমার ক্ষমতা দায়িত্ব ও কর্তব্য, সব কিছুর সুরাহা কিন্তু এখানেই হয়ে যায়। কিন্তু যখনই আমরা রিপুর তাড়নায় অতিষ্ঠ হয়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার মতলবে টু'পাইচ কামানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়, বিপদ তখনি দেখা দেয়।

আমি একচেটিয়াভাবে সরকারি কর্মচারীকে দোষ দেয়ার পক্ষে নই। সরকারি কর্মচারী একজন মানুষ। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো পুণ্য কাজে অনাসক্তি ও পাপ কাজে আসক্তি। শয়তান সবসময় মানুষের উপর ভর করে এর প্ররোচনা দেয়। সেবা প্রদান ও প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হওয়া জরুরী। সেবা প্রার্থীর সংখ্যা কিন্তু দাতার চেয়ে হাজার বা লক্ষগুণ বেশী। উদাহরণ হিসেবে যদি ধরি একটি ইউনিয়নের ভুমি অফিসের কথা। সেখানে একজন ইউনিয়ন ভুমি সহকারী কর্মকর্তা রয়েছেন। একটি ইউনিয়নে জনসংখ্যা চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার বা তার চেয়েও বেশী। সেখানে যদি একজন কর্মকর্তা ভুমি সেবায় জনগণকে হয়রানি করে উৎকোচের বিনিময়ে কাজ করতে চেষ্টা করে আর ইউনিয়নের চল্লিশ হাজার লোক যদি তার বিরোধিতা করে, সে কর্মচারীর কি কোন সাধ্য থাকে অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার! একটি ইউনিয়নে কিন্তু নেতানেত্রী, ক্ষমতাধর ও দায়িত্ববান ব্যক্তির অভাব নেই। উপজেলা ও জেলার ক্ষেত্রেও একই উদাহরণ প্রযোজ্য।

সেবা প্রদানে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ

* সততা: সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রত্যেক কর্মীর সৎ হওয়া উচিত। মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশন করা বা কোনো প্রকার দুর্নীতিতে জড়িত হওয়া উচিত নয়।

* সচেতনতা: প্রত্যেক কর্মীর উচিত তার সেবার মান সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সেবার মান উন্নত করার চেষ্টা করা। একই সাথে, সেবার মান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও প্রয়োজন।

* মানবিকতা: সেবার ক্ষেত্রে মানবিকতা বজায় রাখা জরুরি। সেবা গ্রহীতাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত এবং তাদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করা উচিত।এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করা গেলে সেবার মান উন্নত হবে এবং জনগণ উপকৃত হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের দেশে সার্বিকভাবে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, দপ্তর কিংবা ব্যক্তি জনগণকে যে সেবা দিচ্ছে তা সন্তোষজনক নয়। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারির বেশির ভাগই জনগণকে প্রত্যাশিত সেবা দিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই ঘুষ কিংবা অন্য কোন সুবিধা নিয়ে সেবা দেয়া হচ্ছে জনগণকে। অনেক দপ্তরে ঘুষ দিয়েও মানুষ সেবা পাচ্ছেনা। কিন্তু আমাদের সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি সরকারি দপ্তরেই জনগণকে প্রত্যাশিত সেবা দিতে বাধ্য সরকারি চাকরিজীবিরা। এর জন্য তাদেরকে সরকার বেতন ভাতা দিচ্ছে। আর এই বেতন ভাতা সাধারণ মানুষের ট্যাক্স এর টাকা থেকেই দেয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকার অব্যাহতভাবে বেতন ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করছে সরকারি চাকুরিজীবিদের। তারপরেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বরং বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারিদের ঘুষের মাত্রা বেড়ে গেছে। তাছাড়া, এদেশে অনেক সরকারি দপ্তর রয়েছে, যেখানে হয়রানির ভয়ে মানুষ যেতেই চায়না। বেসরকারি ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে না হলেও অনেক দপ্তরে ও প্রতিষ্ঠানেও মানুষ প্রত্যাশিত সেবা পায় না।

সরকারের বিভিন্ন জনমুখী উদ্যোগ সফল করার দায়িত্ব বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োজিত কর্মকর্তা কর্মচারিদের। কিন্তু তাদের অবহেলা-দুর্নীতির কারণে সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগই বিফল হচ্ছে। তাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদের সেবার মনোভাব নিয়ে দায়িত্বপালন করতে হবে। সরকারি সেবাগুলোকে জনমুখী করতে হবে। এজন্য জনগণ ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে হবে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা এখন মধ্য আয়ের দেশ-এ উন্নীত হয়েছি। এই প্রেক্ষাপটে সরকারি দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনসেবার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হবে, এটাই সকলের প্রত্যাশা। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যেমন কর্মচারীর দায়িত্ব তেমনি প্রতিটি নাগরিকেরও দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। শুধু তোষামোদি নয়, খরগোশের মত সামান্য কিছু করেই মুচে তা দিয়ে ঘুমানো নয়, ক্ষমতার জন্য ক্ষমতা বা চেয়ারে বসে সুযোগসুবিধা ভোগ করা নয়, উটপাখির মত চোখমুখ বুজে থাকা নয়, মিথ্যা বাক্যালাপ শঠতা ও ভন্ডামিগীরি বাদ দিয়ে বাস্তবতার নিরিখে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানে তৎপর হওয়ার মাধ্যমেই 'পাবলিক সার্ভিস ডে' সত্যিকার সার্থকতা বয়ে আনবে। শুধু সুদিনের প্রত্যাশা নয়, সবাই একযোগে সুন্দর বর্তমান ও আগামীর জন্য কাজ করি।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।