প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত
ভুয়া পরিচয়ে ছেয়ে যাচ্ছে ‘সাংবাদিক’ আর ‘মানবাধিকার কর্মী’ : এক ভয়াবহ প্রতারণার জাল
২০২৫ জুন ২৪ ১৮:৪২:৪৪
দিলীপ চন্দ, ফরিদপুর : বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা শহরজুড়ে গড়ে উঠেছে এক নতুন ধরনের প্রতারণাজাল—'ভুয়া সাংবাদিকতা' এবং 'ভুয়া মানবাধিকার কর্মী' পরিচয়। এই পরিচয়কে পুঁজি করে চলছে অবাধ চাঁদাবাজি, প্রতারণা এবং পেশার মর্যাদা হরণের এক নোংরা বাণিজ্য। ৪ হাজার টাকায় মেলে ‘জাতীয় সাংবাদিক’ পরিচয়পত্র, আড়াই হাজারে ‘মানবাধিকার কর্মী’ সনদ, আর মাত্র কয়েকশ টাকায় পাওয়া যায় ‘সম্মাননা পদক’। এই চিত্র এখন বাস্তবতা, যা সাংবাদিকতা পেশার উপর ভয়াবহ প্রশ্ন তুলছে।
কার্ড, টাই, আর সম্মাননাপত্র—‘পেশাদার প্রতারকদের রূপ
প্রথম দেখায় আপনি বিভ্রান্ত হবেন। টাই পরা একজন ব্যক্তি গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন একটি ‘জাতীয় পত্রিকার’ কার্ড। কোমরে বা ফোল্ডারে রয়েছে নানা নামধারী সংগঠনের ‘সার্টিফিকেট’ ও ‘পদক’। অনুষ্ঠানে ঢুকছেন প্রেস লেখা ব্যাজ লাগিয়ে, সাংবাদিকদের ভিআইপি চেয়ারে বসছেন। অথচ তার পরিচয়পত্র, পদক—সবই ভুয়া।
এক উপজেলা শহরে দেখা যায় এমনকি একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিও এসব প্রতীক নিয়ে 'সাংবাদিক' সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্থানীয় মানুষজন তার ছবি তুলছে, হাসছে, কৌতুক করছে। এই চিত্র যেমন করুণ, তেমনি ভয়ানক।
শিক্ষা নয়, মূলধন এখন পরিচয়পত্র
এই ‘সাংবাদিকতা’ বা ‘মানবাধিকার কর্মীত্ব’ পেশা হিসেবে গ্রহণের জন্য এখন আর শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না। অর্ধশিক্ষিত কিংবা একেবারে অশিক্ষিত কেউ অনলাইন থেকে কার্ড ডিজাইন ডাউনলোড করে নিতে পারে। মাত্র ১০ মিনিটেই বানিয়ে ফেলে ‘জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার’ কার্ড। এরপর সেটিই তার পরিচয়, প্রতিপত্তি এবং চাঁদাবাজির অস্ত্র।
তারা নিজেদের পরিচয় দেয় 'বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার জেলা প্রতিনিধি', ‘উপদেষ্টা সম্পাদক’, ‘বিশেষ প্রতিনিধি’, এমনকি ‘চিফ রিপোর্টার’। এদের কেউ কেউ আবার মাইক আর ক্যামেরা হাতে নিয়ে ফেসবুক লাইভেও ‘সংবাদ পরিবেশন’ করছেন।
প্রকৃত সাংবাদিকতার ওপর ভয়াবহ চাপ
একজন প্রকৃত সাংবাদিক যেখানে মাসে ১০-১৫ হাজার টাকার বেশি বেতন পান না, সেখানে এসব 'কার্ডধারী' প্রতারক নিয়মিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফার্মেসি, ক্লিনিকে গিয়ে 'ডোনেশন', 'সাহায্য' বা ‘কভারেজ ফি’ চেয়ে টাকা আদায় করছে। অনেক সময় ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় করছে। সাংবাদিক পরিচয়ে পুলিশের কাছ থেকেও বিশেষ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এক প্রবীণ সাংবাদিক এ বিষয়ে বলেন, “আজকাল সত্যিকারের সাংবাদিক হতে লজ্জা লাগে। সাধারণ মানুষ ভাবে আমরাও ওদের দলে।”
মানবাধিকার কর্মীত্বের নামে দুর্নীতির বিস্তার
ভুয়া মানবাধিকার কর্মীরাও পিছিয়ে নেই। তারা সাধারণ কৃষকের কাছে গিয়ে মামলা, গ্রেপ্তার, আইনি ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছে। প্রান্তিক মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে তৈরি হয়েছে প্রতারণার নেটওয়ার্ক।
এর পেছনে কারা?
এ সবের মূলে রয়েছে কিছু কথিত অনলাইন পত্রিকা ও মানবাধিকার সংগঠন। নাম দেখলে মনে হবে আন্তর্জাতিক কোনো সংগঠন—‘জাতীয় মানবাধিকার ফোরাম’, ‘গ্লোবাল জাস্টিস মিডিয়া’ ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর নেই কোনো সরকারি অনুমোদন বা বৈধতা। মাসে মাত্র ২০০-৩০০ টাকা সদস্য ফি দিলেই ‘জেলা প্রতিনিধি’ বা ‘ব্যুরো চিফ’ হওয়া যায়। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এই ‘সদস্য বানাও-টাকা তোল’ পদ্ধতি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানে, তবু চুপ কেন?
পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা—সবাই এসব বিষয়ে অবগত। কিছু ক্ষেত্রে ধরপাকড়ও হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব প্রতারকের পেছনে থাকে স্থানীয় কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
সমাধান কোথায়?
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন—
সরকারি রেজিস্ট্রেশনের বাধ্যবাধকতা
প্রতিটি গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাকে নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনতে হবে।
কার্ডধারীদের যাচাই-বাছাই
পুলিশ প্রশাসন ও প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রতিটি সাংবাদিক পরিচয়পত্র যাচাই করতে হবে।
সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাবের কঠোর পদক্ষেপ: প্রকৃত ও ভুয়া সাংবাদিকদের মধ্যে পার্থক্য রক্ষার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কার্যকর স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে।
জনসচেতনতা
সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে যে পরিচয়পত্র থাকলেই কেউ সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মী হয়ে যায় না।
শেষ কথা
সাংবাদিকতা ও মানবাধিকার রক্ষা—দুইটি অত্যন্ত সম্মানজনক ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র। কিন্তু ভুয়া পরিচয়ে এসব পেশাকে যারা কলুষিত করছে, তারা কেবল সমাজের জন্যই নয়, দেশের তথ্য ও বিচার ব্যবস্থার জন্যও হুমকি। এখনই যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে এ পেশাগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আরও কমে যাবে।
লেখক : সংবাদকর্মী