ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস 

মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে আমাদের ভূমিকা

২০২৫ জুন ২৬ ১৩:০৮:৫১
মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে আমাদের ভূমিকা

ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


মাদকসেবন আজকের বিশ্বের একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তির জীবন ধ্বংসের পাশাপাশি এটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর বিস্তৃত নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই ভয়াবহ সমস্যার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৬ জুন পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস। এ দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হলো— মাদকের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, মাদকবিরোধী কার্যক্রমে বিশ্বজনীন সংহতি তৈরি এবং সুস্থ সমাজ গড়ার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ।

আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবসের পটভূমি
জাতিসংঘ ১৯৮৭ সালে মাদকের অবৈধ ব্যবহার ও অবৈধ পাচার বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২৬ জুনকে International Day against Drug Abuse and Illicit Trafficking হিসেবে ঘোষণা দেয়। এই দিনটি মাদকবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং বিভিন্ন দেশ এ উপলক্ষে জনসচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করে।

দেশে বর্তমানে ৩২ ধরনের মাদক সেবন চলছে। এ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামের যেসব মাদক উদ্ধার হয়েছে সেগুলো হচ্ছে হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেড্রিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন(বুপ্রেনরফিন),টেরাহাইড্রোবানাবিল, এক্সএলমুগের, মরফিন, ইয়াবা, আইএসপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন। এছাড়া ইনোকটিন, সিডাক্সিনসহ বিভিন্ন ঘুমের ট্যাবলেট, জামবাকসহ ব্যথানাশক ওষুধ কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

মাদকের ভয়াবহতা ও প্রভাব
১. ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি
মাদক ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দেয়।

মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি হয়, যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আচরণে প্রভাব ফেলে।

আত্মহত্যা বা সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

২. পারিবারিক ভাঙন
মাদকাসক্ত ব্যক্তির কারণে পরিবারে অশান্তি ও আর্থিক সংকট দেখা দেয়।

পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে, সন্তানদের বেড়ে ওঠায় প্রভাব পড়ে।

৩. সামাজিক অবক্ষয়
চুরি, ছিনতাই, হত্যাসহ নানা অপরাধে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সম্পৃক্ততা বাড়ে।

সমাজে অনৈতিকতা ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়।

৪. অর্থনৈতিক ক্ষতি
চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পায়।

কর্মক্ষম যুবসমাজের একাংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ায় জাতীয় উৎপাদনশীলতা কমে যায়।

বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি
বাংলাদেশে মাদক সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনসহ নানা ধরণের মাদকদ্রব্য সীমান্তপথে প্রবেশ করছে এবং তরুণ সমাজে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকা, শহরের বস্তি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে মাদক চক্র সক্রিয় রয়েছে।

মাদকের কারণসমূহ
১. কৌতূহল ও সহচর প্রভাব
তরুণ বয়সে বন্ধুদের প্ররোচনা, আধুনিকতার অনুসরণ বা কৌতূহল থেকে অনেকেই মাদকে জড়িয়ে পড়ে।

২. পরিবারিক সমস্যা
দাম্পত্য কলহ, অবহেলা বা পারিবারিক অশান্তির কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে কেউ কেউ মাদকগ্রহণ শুরু করে।

৩. বেকারত্ব ও হতাশা
জীবনের লক্ষ্য হারানো, চাকরির অভাব ও হতাশাজনিত কারণে তরুণ সমাজ মাদকের দিকে ধাবিত হয়।

৪. সহজলভ্যতা ও চোরাচালান
মাদক সহজে পাওয়া যায়, এবং সীমান্তে চোরাচালান কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছে।

আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও সাফল্য
জাতিসংঘের UNODC (United Nations Office on Drugs and Crime) মাদকের ব্যবহার ও পাচার রোধে বিশ্বজুড়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অনেক দেশে হামের্ন্তাভিত্তিক প্রোগ্রাম, মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্র, সচেতনতামূলক শিক্ষা প্রোগ্রাম এবং আইনি কাঠামো উন্নত করার মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি অর্জন করেছে।

বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ
বাংলাদেশ সরকারও মাদক নির্মূলে নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রধান পদক্ষেপগুলো হলো:_ * মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযান জোরদার করা।

*মাদকবিরোধী আইন প্রণয়ন ও সংশোধন * পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন ও কাউন্সেলিং কার্যক্রম।* সীমান্তে নজরদারি ও চোরাচালান দমন।

ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মে মাদকের অবস্থান
ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মে মাদক বা নেশাজাত দ্রব্যকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

কুরআনে বলা হয়েছে:"হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ধারণের তীর শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব, এগুলো থেকে দূরে থাকো।" (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত ৯০)

হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মেও আত্মসংযম ও নেশা থেকে বিরত থাকার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিরোধ
মাদকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো শিক্ষা। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মিলে একটি সম্মিলিত সচেতনতা তৈরি করতে পারলে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করা সম্ভব।

সচেতনতামূলক কার্যক্রম

* স্কুল-কলেজে মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইন। * শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া। * সফল মাদক নিরাময়ের গল্প প্রচার।

তরুণদের করণীয়
* নিজেকে সচেতন রাখা ও অন্যদের সচেতন করা। * মাদকাসক্ত বন্ধুদের সহযোগিতা করা নিরাময়ে। * খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও সমাজসেবায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা।

মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে আমাদের ভূমিকা
একটি মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে প্রতিটি নাগরিকের ভূমিকা অপরিসীম। শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারের পক্ষে একা এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।

করণীয়
সন্দেহজনক মাদক চক্র সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দেওয়া।

প্রতিবেশী, বন্ধু বা আত্মীয়দের মধ্যে কেউ মাদকে জড়িয়ে পড়লে সহযোগিতার হাত বাড়ানো।

সামাজিক আন্দোলন ও গণসচেতনতা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা।

মাদক ব্যবহারে কারণে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়-

১. মাদক ব্যবহারে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষতি .শ্বাস, প্রণালীতে ক্ষতি.খুসখুসে কাশি থেকে যক্ষা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, ক্যান্সার, শ্বাস–প্রশ্বাস ক্ষীণ হওয়া।

২.চোখের ক্ষতি : চোখের মনি সঙ্কুচিত হওয়া, দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া।

৩.লিভারের ক্ষতি : জন্ডিস, হেপাটাইটিস, সিরোসিস ও ক্যান্সার।

৪. কিডনীর ক্ষতি : কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, ঘন ঘন সংক্রমণ হওয়া, পরিশেষে কিডনী অকার্যকর হয়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্রের কার্যকারীতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি।

৫. হৃদযন্ত্র ও রক্ত প্রণালীতে ক্ষতি : হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, হূদযন্ত্র বড় হয়ে যাওয়া, হূদযন্ত্রের কার্যকারীতা হ্রাস পাওয়া।

৬. রক্ত কণিকার সংখ্যায় পরিবর্তন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, রক্তস্বল্পতা ইত্যাদি।

৭.খাদ্য প্রণালীতে ক্ষতি: রুচি কমে যাওয়া, হজম শক্তি হ্রাস পাওয়া, আলসার, এসিডিটি, কোষ্ঠ কাঠিন্য, ক্যান্সার ইত্যাদি।

৮.ত্বকের ক্ষতি : ভিটামিন ও পুষ্টির অভাবে ত্বক হয়ে উঠে খসখসে শুস্ক। চুলকানী, ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, ফোঁড়া, ঘা ইত্যাদি।

৯. যৌন ক্ষমতা ও প্রজননের ক্ষতি : যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, যৌন স্পৃহা কমে যাওয়া, বিকৃত শুক্র থেকে বিকৃত সন্তানের জন্ম, সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা।

১০. সিফিলিস, গনোরিয়া, এইডস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হওয়া। মেয়েদের ক্ষেত্রে এ প্রভাব আরো মারাত্মক। গর্ভের সন্তান বিকৃত হয়ে যাওয়া, মৃত সন্তান প্রসব করা, জকোলীন শিশুর স্বল্প ওজন, জন্মের সাথে সাথেই নবজাতকের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হওয়া।

১১. মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্র এবং মানসিক ক্ষতি : নেশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রলাপ বকা, আত্মহত্যার প্রবণতা, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে অসচেতনতা, মাথা ঘুরানো, চিন্তা শক্তি লোপ পাওয়া, অমনোযোগিতা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, অস্থিরতা ও অধৈর্য অবস্থা, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, উদ্বেগ, ভয় পাওয়া, বিষন্নতা ইত্যাদি মানসিক রোগ দেখা দেয় অনেক ক্ষেত্রে।

আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবসের তাৎপর্য
এই দিবসটি শুধু একটি প্রতীকী দিন নয়, এটি একটি প্রতিজ্ঞার দিন— আমরা যেন নিজে মাদকমুক্ত থাকি এবং অন্যদেরও সচেতন করি। এই দিনে আমাদের নতুন করে সংকল্প গ্রহণ করা উচিত—“মাদক নয়, জীবনকে ভালোবাসি”

পরিশেষে বলতে চাই, মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার ও প্রচারণা করতে হবে মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গীর্জার ফাদারদের মাধ্যমে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে মাদক সেবনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সকল সরকার, রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদদের দেশ ও সমাজের স্বার্থে একই প্লাটফর্মে থেকে কাজ করতে হবে।তাহলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সহজ ও টেকসই হবে। আর মাদক-ব্যবসায়ী ও চোরাচালানকারীরা দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু । এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। মাদকব্যবহারের ধ্বংসাত্বক প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে মাদকমুক্ত সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার কোনও বিকল্প নেই।

তাই আসুন, আমরা সবাই মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করি, তাদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাব্যবস্থার সুযোগ করে দিই। তাহলেই তারা সমাজের বোঝা না হয়ে বরং সুস্থ হয়ে পরিবারে ফিরে আসবে, তারাই সমাজকে সঠিকপথে পরিচালিত করবে।তাই আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস আমাদের সেই উদ্যোগকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং নতুনভাবে লড়াই করার উৎসাহ জোগায়। আসুন, আমরা সকলে একসাথে শপথ নেই— মাদক নয়, আমরা জীবনকে বেছে নেবো। এভাবেই গড়ে উঠবে একটি সুস্থ, সচেতন ও মাদকমুক্ত বাংলাদেশ।

লেখক : সংগঠক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।