প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত
টাঙ্গাইলে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ে ভুল করায় রোগীর মৃত্যু
২০২৫ জুন ২৬ ২০:০২:৫০
সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ‘ও’ পজেটিভ রক্তের বদলে ‘এবি’ পজেটিভ রক্ত পুশ করায় রোগীর নানা ধরনের উপসর্গের যন্ত্রণায় সাতদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বুধবার (২৫ জুন) দিনগত রাত আড়াইটার দিকে আব্দুর রউফ (৭০) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ে ভুল ও বৃদ্ধের মৃত্যু নিয়ে শহরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, দেলদুয়ার উপজেলার কৌপাখী গ্রামের মৃত আমজাদ হোসেনের ছেলে আব্দুর রউফ নামে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধ হাড়ের ক্ষয়রোগ সহ কয়েকটি রোগের উপসর্গ নিয়ে গত ১৮ জুন (বুধবার) টাঙ্গাইলের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। ভর্তির পর চিকিৎসকরা জরুরি ভিত্তিতে রোগীকে রক্ত দেওয়া প্রয়োজন বলে স্বজনদের জানায়। স্বজনরা জানতেন আব্দুর রউফের রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজেটিভ। তাই ওইদিনই ‘ও’ পজেটিভ রক্তের ডোনার খুঁজে হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে উপস্থিত করেন।
ডোনার এবং রোগীর রক্ত ক্রস ম্যাচিং করে হাসপাতালের ল্যাব টেকনোলজিষ্ট রঞ্জু জানান, রোগীর রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজেটিভ নয়, ‘এবি’ পজেটিভ। তাৎক্ষণিকভাবে রোগীর স্বজনরা ‘এবি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্তের ডোনার খুঁজেন। ওইদিনই সন্ধ্যায় ‘এবি’ পজেটিভ রক্তের ডোনার এনে হাসপাতালে উপস্থিত করলে ল্যাব টেকনোলজিষ্ট রঞ্জু রক্ত সংগ্রহ করেন। চিকিৎসক সন্ধ্যার পর রোগীর শরীরে ‘এবি’ পজেটিভ রক্ত পুশ করেন। প্রায় ৪০ মিনিট রক্তনালী দিয়ে রক্ত পুশ হয়। পুশ হওয়ার পরপরই রোগী আব্দুর রউফ নানা ধরনের উপসর্গে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন।
তাৎক্ষণিক চিকিৎসক রক্ত দেওয়া বন্ধ করে দেন। রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে চিকিৎসকরা টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে স্থানান্তর(রেফার) করেন। সেখানে চিকিৎসকরা রোগীর শরীরে হিমোগ্লোবিন কম দেখে তাৎক্ষণিকভাবে রক্ত দেওয়ার জন্য স্বজনদের রক্তের ডোনার আনতে বলেন। ‘এবি’ পজেটিভ রক্তের গ্রুপের ডোনার সেখানে উপস্থিত করলে তাদের রক্ত ক্রস ম্যাচিংয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেখতে পায় রোগীর রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজেটিভ।
এমতাবস্থায় রোগীর রক্তের সঠিক গ্রুপ নির্ণয়ের নিমিত্তে রোগীর স্বজনরা টাঙ্গাইল শহরের মেডিনোভা হসপিটাল, এশিয়া হসপিটাল, আল মোহনা হসপিটাল ও ক্লিনিক সহ আরও কয়েকটি ক্লিনিকে গ্রুপ নির্ণয় করা হয়। এরমধ্যে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এশিয়া হসপিটাল এবং আল মোহনা হসপিটালের রিপোর্টে ‘ও’ পজেটিভ রিপোর্ট আসে। পক্ষান্তরে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল এবং মেডিনোভা ক্লিনিকের রিপোর্টে রক্তের গ্রুপ ‘এবি’ পজেটিভ আসে। এ সময় রোগীর স্বজনরা রক্তের গ্রুপের রিপোর্ট সরকারি দুই হাসপাতালে ধরনের পাওয়া এবং রোগীর শরীরে ভুল রক্ত পুশ হওয়া নিয়ে চিন্তিত ও হতাশ হয়ে পড়ে।
রোগীর স্বজনরা জানায়, চিকিৎসক ভুল রিপোর্টের ভিত্তিতে অসাবধানতাবশত; রোগীর শরীরে রক্ত পুশ করায় সারারাত জ্বর-ঠান্ডায় ঝাকুনি উঠে রোগীর অবস্থা খুবই সোচনীয় হয়ে পড়ে। ওই রাতে তাদের মনে হয়েছিল রোগীকে বোধহয় আর বাঁচানো গেলনা। এরপর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা দ্রুত রোগীকে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর(রেফার) করেন।
স্বজনরা জানায়, সরকারি দুটি হাসপাতালের দায়ত্বরত চিকিৎসক ও ল্যাব টেকনোলজিষ্টরা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করেছে। তাদের অবহেলায়ই রোগীর শরীরে ভুল রক্ত পুশ করা হয়েছে।
রোগী আব্দুর রউফের ছেলে মো. উজ্জল ওরফে রানা জানান, রক্তদাতা ও রোগীর রক্তের ক্রস ম্যাচিংয়ে রোগীর ‘ও’ পজেটিভ না হয়ে ‘এবি’ পজেটিভ বলেছেন জেনারেল হাসপাতালের ল্যাব টেকনোলজিষ্ট রঞ্জু। ফলে ‘ও’ পজেটিভ রক্তদাতা চলে যান। এরপর রোগীকে জরুরি রক্ত দেওয়া প্রয়োজন হওয়ায় ‘এবি’ পজেটিভ রক্তদাতা এনে ক্রস ম্যাচিং করে রোগীর শরীরে ‘এবি’ পজেটিভ রক্ত পুশ করা হয়।
তিনি জানান, রক্ত পুশ করার প্রায় ৪০ মিনিটের মধ্যে রোগীর শরীরে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্বরত চিকিৎসক রক্ত দেওয়া বন্ধ করে দেন। এরপর তার বাবাকে চিকিৎসকরা টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন।
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের ল্যাব টেকনোলজিষ্ট রঞ্জু জানান, তিনি বার বার রক্তের গ্রুপ ম্যাচিং করেছেন। প্রতিবারই ‘এবি’ পজেটিভ এসেছে। তিনি সেটাই রিপোর্ট করেছেন।
টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্ববধায়ক ডা. সাদিকুল ইসলাম জানান, তারা দায় এড়াতে পারেন না। এটা হাসপাতালের টেকনোলজিষ্টের ত্রুটি ছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে রোগীর স্বজনদের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলে তারা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রগণ করবেন।
টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আব্দুল কুদ্দুস জানান, রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ভুল রক্ত পুশ করায় এখানে রক্তের ম্যাচিং বিষয়ের একজন ডাক্তার যথাযথ চিকিৎসা দিয়েছেন। তবে উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীকে অন্যত্র নেওয়ার জন্য স্বজনদের পরামর্শ দেওয়া হলেও তারা করেন নাই।
(এসএএম/এএস/জুন ২৬, ২০২৫)