প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
রাষ্ট্রের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থ ভান্ডার মেরামতের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়
২০২৫ জুন ৩০ ১৬:০৬:০০
চৌধুরী আবদুল হান্নান
“প্রশ্ন হলো আইনের ধারা পরিবর্তনে এত বিলম্ব কেন? যেখানে আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন একজন চৌকস ব্যক্তি যিনি আইনের একজন শিক্ষকও। শক্ত আইন আছে, প্রয়োগ নেই, আবার প্রয়োগ করতে গেলে বের হয় যত দুর্বলতা।”
সরকারের মাল বলে একটা কথা আছে, ব্যাংক থেকে গত সরকারের ১৫ বছরে লুটে নেওয়া অর্থকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি তাই ভাবছেন? অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে, যেন কারও দায় নেই।
এক সময় ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ ছিল না, শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সাহেবরা সরকারের অনৈতিক নির্দেশ মেনে কাজ করেছেন, প্রতিবাদ করেননি। যারা কর্মক্ষেত্রে নীতিজ্ঞান সমুন্নত রেখে কাজ করতে পারেন না, তাদের শিক্ষার কী দাম আছে?
আমানতকারীদের জমানো টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে সব লুটপাট সম্পন্ন হয়েছে, সরকারেরও পতন হয়েছে। তারা নিজেরা ডুবেছে, রাষ্ট্রকেও ডুবিয়েছে।
ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যাংক ব্যবস্থাকে পূনর্গঠনে তো হাত দিতে হবে। ভাবনাটা এমন যে, অপকর্ম করেছে বিগত সরকার, আমাদের কী? তাই তো ঢিলেঢালা ভাব আর আন্তরিকতার অভাব।
বস্তুত বর্তমান সরকার জনগণের নির্বাচিত নয়, আপদকালীন অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের দায় কম, দায়িত্ব বেশি। রাষ্ট্রকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ তারা যতটা করতে সমর্থ হবেন, তা নিয়ে আমাদের সন্তষ্ট থাকতে হবে। অবশিষ্ট কাজ নির্বাচিত সরকার এসে করবে।
রাষ্ট্র মেরামতের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের অর্থ ভান্ডার ব্যাংক ও আর্থিক খাত মেরামতে অগ্রাধীকার দিতে হবে।
গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নিয়ে প্রত্যক্ষ করলেন, আর্থিক খাতে এত বড় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে যা বাইরে থেকে কল্পনাও করা যাবে না। এত দুর্নীতি পৃথিবীর কোথাও হয়নি।
বিভিন্ন সভা-সেমিনারে গভর্নরের দেওয়া বক্তব্যে অনেকের মনে হয়েছে, তিনি অনেকটা দিশেহারা। তা না হলে দায়িত্ব নিয়েই তিনি এমন বক্তব্য কেন দেবেন যে, অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পথে, কিছু কিছু ব্যাংকের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ; একসঙ্গে টাকা তুলতে যাবেন না, তা হলে টাকা পাবেন না।
গভর্নরের এমন নেতিবাচক বক্তব্যে আমানতকারীরা আতঙ্কিত হয়ে সবাই টাকা তুলতে ব্যাংকে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ব্যাংক ব্যবস্থার অভিভাবক যখন এমন বিস্ফোরক বক্তব্য দেন, মানুষ আতঙ্কিত না হয়েই পারে না। গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি সার্বিক কর্ম পরিচালনায় যদি কখনও হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন, তাতে দ্রুত সর্বনাশ হওয়ার আশংকা।
কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের কোনো একটি শাখার সব আমানতকারী যদি একসাথে টাকা তুলতে যায়, ব্যাংক তো তাদের চাহিদা মতো টাকা দিতে পারবে না। এর অর্থ এই নয় যে, ব্যাংকটির অবস্হা খারাপ বা অচিরেই দেউলিয়া হয়ে যাবে।
প্রকৃত প্রস্তাবে জনআস্থা এবং বিশ্বাস ব্যাংক ব্যবস্হার ভিত্তিমূল। পরবর্তীতে গভর্নর মহোদয় যখন সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন- “আমানতকারীদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নিরাপত্তায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কেউ আমানতের টাকা হারাবেন না।” ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করলো।
আসলে এমনটিই তো বিধান, মানুষ নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছে, সরকার অনুমোদিত ব্যাংকে, টাকা ফেরত না পাওয়ার প্রশ্ন আসবে কেন ? সরকারই তো এখানে জামিনদার।
কয়েক মাস পূর্বে পত্রিকার খবরে জানা গিয়েছিল সরকার পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে এবং তা হলো পাচারকারীদের সাথে আপসরফা। এখানে একটি সমস্যার কথা বলা হয়েছিল, পাচারকারীদের সাথে আপসরফা করতে হলে বিদ্যমান মানি লন্ডারিং আইনের সংশোধনী/পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রশ্ন হলো আইনের ধারা পরিবর্তনে এত বিলম্ব কেন? যেখানে আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন একজন চৌকস ব্যক্তি যিনি আইনের একজন শিক্ষকও। শক্ত আইন আছে, প্রয়োগ নেই, আবার প্রয়োগ করতে গেলে বের হয় যত দুর্বলতা।
অন্যদিকে গত ১৩ জুনের কয়েকটি পত্রিকা বলছে— অর্থ পাচারে অভিযুক্তদের সঙ্গে সমঝোতার কথা ভাবছে বাংলাদেশ।
মানে কী? আপসরফা আর সমঝোতার মধ্যে পার্থক্য কী?
অনেকেই বলবেন, কাজের কাজ কিছু নেই, আছে শুধু কথামালা, কথার ফুলঝুরি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের কথায় ধারাবাহিকতা থাকছে না।
গভর্নর সাহেব ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম ফিন্যন্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন -“অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর মামলাগুলোর ক্ষেত্রে আর্থিক সমঝোতা “অন্যতম বিকল্প” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।”
গভর্নর আরও বলেছেন— অর্থ পুনরুদ্ধারে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মামলা পরিচালনার জন্য তিনি ১০ কোটি ডলার পর্যন্ত অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্য রাখছেন। এক্ষেত্রে বলতেই হবে, যেখানে টাকার গন্ধ সেখানেই মৌমাছির আগমন, টাকা তো মধুর চেয়ে মিষ্টি।
পাচারকৃত অর্থ আদায়ে অনেকে অতি উৎসাহী হয়ে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি বাগিয়ে নিতে পারেন, পাচারকারীর বিদেশে নির্মিত সুরম্য ভবনে আতিথ্য গ্রহণ করলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। আমাদের লোকদের নাড়িনক্ষত্র তো আমাদের চিরচেনা।
আমাদের অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন — যারা টাকা পাচার করেন তারা অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক। তা তো বটেই। তা না হলে কি তারা এত দক্ষ, বিচক্ষণ কর্মকর্তা, নির্বাহীদের পকেটে পুরে রাখতে পারতেন?
আত্মসাতকৃত বা পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে সরকারের বর্তমান উদ্যোগ আপসরফা বা সমঝোতার দিকে অগ্রসর হতে এখনই মানি লন্ডারিং আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। এখানে অহেতুক বিলম্ব হলে, মানুষ ভাবতে শুরু করবে আপনারা কেবল লোভনীয় পদ-পদবি উপভোগ করছেন, দায়িত্ব পালন করছেন না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।