ঢাকা, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষ রোপণের নবজাগরণ প্রয়োজন 

২০২৫ জুন ৩০ ১৬:২৯:৪৭
পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষ রোপণের নবজাগরণ প্রয়োজন 

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


আমরা সবাই সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকতে চাই এটা আমাদের সকলেরই অনুভূতি এবং একান্ত চাওয়া। এই চাওয়াকে বাস্তবে রুপ দিতে প্রয়োজন আমাদের একান্ত সদিচ্ছা। শুধু মাত্র সরকারের পরকিল্পনার উপরই দেশের পরিবেশ সুন্দর হওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। এই পরিবেশ কে সুন্দর রাখতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বৃক্ষ। আমরা সবাই জানি বৃক্ষ আমাদের অনেক উপকার করে যদিও এটা কেউ অস্বীকার করে না। প্রতিনিয়তই বৃক্ষের চাহিদা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি আমাদের জলবায়ুর প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য। জলবায়ু যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা আমাদের জন্য জটিল হয়ে পড়ছে। বৃক্ষ একদিকে যেমন আমাদের অক্সিজেন দিচ্ছে অন্যদিকে দিচ্ছে আর্থিক সহায়তা। এবারের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বৃক্ষ রোপন।

পরিবেশ সুন্দর রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে যে সব উপাদান তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বৃক্ষ। কিন্তু আমরা বৃক্ষ রোপনের কাজটি দায়সারাভাবে যেটা করছি তাতে ফল পাচ্ছি কম। এটি করার সময় অবশ্যই লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন রোপণকৃত বৃক্ষ সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে বেড়ে উঠবে কি না ? এই যে বৃক্ষ আমরা রোপণ করছি তা সত্যিকার ভাবে বেড়ে উঠে আমাদের কাজে লাগবে কি না সেটা অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত। না হলে তার জন্য যে সময় ও অর্থ ব্যয় করছি তা বৃথাই থেকে যাবে। বৃক্ষরোপণের জায়গা এবং সময় অবশ্যই আমাদের সঠিকভাবে জানা উচিত। তবে এটা সত্য যে সময়কে নির্দিষ্ট করে বেঁধে না দিয়েও সঠিক পরিচর্চ্চার মাধ্যমে বৃক্ষকে বড় করে তোলা সম্ভব। শুধুমাত্র চারা রোপণ করলেই এর কাজ শেষ হয়ে যায় না। আমাদের দেশে বৃক্ষরোপণের সময় বর্ষাকালকে ধরে নেয়া হয় তাই বর্ষাকালকে কাজে লাগাতে হবে। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলামে লেখা থেকে কিছু বিষয় তুলে ধরছি।

বৃক্ষের আবর্তন কাল অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি (৫-১০ বছর), মধ্যমেয়াদি (১০-১৮ বছর) ও দীর্ঘমেয়াদি (১৮-৪০ বছর) বৃক্ষের প্রজাতি নির্বাচন করা প্রয়োজন। প্রজাতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেশি প্রজাতির চারা রোপণের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। যদি চারা নার্সারি থেকে সংগ্রহ করেন তাহলে উন্নত মানের চারা বাছাই করুন এবং দুর্বল ও রুগ্ন চারা বাতিল করুন। বেশি বয়সের চারা রোপণ না করাই ভালো। মনে রাখবেন, বৈদ্যুতিক লাইনের নিচে বৃক্ষরোপণ করা উচিত নয়। উপযুক্ত মৌসুমে গাছের চারা রোপণের পাশাপাশি তাদের অনবরত পরিচর্যাও জরুরি। তা না হলে গাছের চারা টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। অনেকে বাসার ছাদ এমনভাবে তৈরি করে নেন, যেন বাগান করতে সুবিধা হয়। নিজের বাসা হলে তো নিজের ইচ্ছামতো সাজিয়ে নেওয়া সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পানি দেওয়া ও ভালো নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও চারা রোপণের পর চারা টিকিয়ে রাখাই বড় কাজ। এ জন্য প্রথমেই গরু, ছাগল বা অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীর হাত থেকে চারাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। চারা রোগাক্রান্ত হলে রোগ-বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় বনকর্মী বা কৃষিকর্মীর পরামর্শ নিতে হবে। এই গরমের মধ্যে চারার গোড়ায় প্রয়োজনমাফিক পানি দেয়ার বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

অপরদিকে চারাগাছে প্রয়োজনীয় সার দেওয়া জরুরি। সঠিকভাবে চারা বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত আলো-বাতাস। প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত আলো বাতাসে গাছ খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে। যেকোনো জাতের গাছের জন্য যা খুবই দরকারি। তাই বাড়িতে এমন স্থানে গাছ রাখুন, যেখানে নিয়মিত আলো-বাতাস মেলে। পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের দেশে বৃক্ষরাজি অনেক কম। তাই সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছরই সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। যেমন- পরিবেশ মেলা, বৃক্ষ মেলা, সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি, বসতবাড়ি বনায়ন কর্মসূচি, বুক্ষরোপন কমৃসূচি, ফলদ-বনজ ভেষজ বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম, ফলদ বৃক্ষমেলা। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন থেকে বৃক্ষরোপন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সমস্যাটা হলো ব্যক্তিগতভাবে আমরা যে চারা রোপন করি তা দেখভাল করার জন্য আমরা কিছুটা চেষ্টা করি কিন্ত সরকারিভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিক যে চারা বোপন করা হয় তা সঠিকভাবে পরিচর্চ্চা করা হয় না। যার ফলে সে অর্থ ও ও শ্রম বিনিয়োগ করা হয় তা সম্পূর্ণ বৃথা যায়। এ থেকে উত্তোরণের জন্য পরিবেশ ভালো রাখার প্রতি যে দায়ব্ধতা তা আরো বাড়াতে হবে আমাদের।

অন্যদিকে প্রতিবছরই আমাদের যে পরিমাণে কাঠের চাহিদা তা কিন্তু আমরা পূরণ করতে পারছি না। যার কারণে অপরিপক্ক গাছ নিধন করছি। অথবা অর্থের প্রয়োজন থাকায় গাছ বেশিরভাগ গাছ অসময়ে বিক্রি করে দিচ্ছি। এর প্রেক্ষিতে সে পরিমাণে গাছ রোপন করছি না। এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের মানুষ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে তার প্রেক্ষিতে ঘর বাড়ি নির্মাণ করতে হচ্ছে। এই ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে গাছ যেমন নিধন করছি অন্যদিকে গাছ লাগানোর জায়গাও সংকোচিত হয়ে আসছে। এককথায় বলা যায় দিনকে দিন গাছের প্রয়োজনীয়তা বাড়লেও গাছ লাগানোর জায়গা কমে আসছে। যার প্রেক্ষিতে অল্প জায়গায় সঠিক সময়ে পরিকল্পনা মাফিক গাছ লাগানো জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুবা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের মূল্য দিতে হবে। সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি কারন এই ক্ষেত্রে ব্যক্তি জাগরণ প্রয়োজন। এছাড়াও প্রামেগঞ্জে দেখা দিয়েছে জ¦ালানি সংকট। মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর। বৃক্ষ রোপণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি জাগরণ ঘটলে সামাজিকভাবে এর প্রভাব পড়বে। মানুষকে বুঝাতে হবে বৃক্ষ রোপনের প্রয়োজনীয়তা। আর একটি বিষয় হলো কাঠ এবং ফল উপযোগী যেসব বৃক্ষ রয়েছে তা আমরা রোপন করছি কিন্তু পরিবেশ উপযোগী কিংবা ঔষধি বৃক্ষ আমরা রোপন করছি না।

মনের মাঝে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীতা জাগ্রত না হলে আইন করে বা সরকারি হস্তক্ষেপে তা সফল করা সমভব হবে বলে মনে হয় না। সরকার কর্তৃক গাছ রোপন ও কর্তনের বিষয়ে একটি বিধিনিষেধ আরোপ করা জরুরি। যে পরিমাণে ভূমি অব্যহৃত রয়েছে সে সব ভূমিকে কিভাবে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি আইন প্রনয়ণ এখন সময়ের দাবী। আমাদের সমস্যাটা হলো এই বিষয়টার গুরুত্ব আমরা অনুধাবন করতে পারছি না। সবকিছুর মধ্যেই গাছাড়া ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু কিছু বিষয় থাকে যে, যা থেকে বিকল্প কোন পথে উদ্ধার হওয়া যায় না। এটা এমনই একটা বিষয়। তাই সময়ের দাবী সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে বৃক্ষরোপন করা। না হলে পরিবেশের যে বিপর্যয় তা রোধ করা সম্ভব হবে না। সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণের মাঝে এ বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এ বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের পাঠ্য বইয়ে আরো গুরুত্বও বাড়াতে হবে যাতে ভবিষৎত প্রজন্ম আরো সচেতন হয়ে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাব কাটিয়ে উঠা যায়।

লেখক :শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।