ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা: ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন ও সংগ্রামের দিন

২০২৫ জুন ৩০ ১৬:৪১:১৩
অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা: ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন ও সংগ্রামের দিন

ওয়াজেদুর রহমান কনক


২৭ জুন পালিত হয় ‘ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা দিবস’—একটি বৈশ্বিক স্বীকৃতি, যা বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য হ্রাসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর অপরিসীম অবদানকে তুলে ধরার জন্য নির্ধারিত। জাতিসংঘ ২০১৭ সালে দিবসটি ঘোষণা করে, এই উপলব্ধি থেকে যে, বিশ্বজুড়ে ৯০ শতাংশেরও বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই এই খাতের অন্তর্ভুক্ত এবং তারা বৈশ্বিক জিডিপির একটি বৃহৎ অংশ এবং কর্মসংস্থানের প্রায় ৬০ শতাংশ সৃষ্টি করে। ক্ষুদ্র উদ্যোগ বলতে সেইসব ব্যবসাকে বোঝানো হয়, যেগুলো তুলনামূলকভাবে সীমিত মূলধন, কর্মীসংখ্যা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে পরিচালিত হলেও, তাদের প্রভাব বিস্তৃত ও গভীর। এই উদ্যোক্তারা বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে যুক্ত হয়, উদ্ভাবন ঘটায়, এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখে।

MSME দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা ও সংকট বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং সরকার, উন্নয়ন সংস্থা ও বিনিয়োগকারীদের এই খাতে আরও নীতি সহায়তা ও আর্থিক সুরক্ষা দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা। এটি এমন একটি খাত, যেখানে প্রবেশাধিকার তুলনামূলক সহজ, ফলে তরুণ, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থানের বড় সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু এই খাতের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বৈষম্যপূর্ণ নীতিমালা, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণপ্রাপ্তির জটিলতা, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এবং বাজারে প্রবেশাধিকারে সীমাবদ্ধতা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের এগিয়ে যেতে বাধা দেয়। তাই এই দিবস উদ্যোক্তাদের কণ্ঠস্বরকে নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছে দেওয়ার একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম, যাতে ক্ষুদ্র উদ্যোগ আর ছোট না থাকে, বরং হয়ে ওঠে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেতৃত্বকারী শক্তি।

২৭ জুন পালিত হয় ‘ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা দিবস’, যা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত Micro-, Small and Medium-sized Enterprises Day (MSME Day) নামে। বাংলাদেশে এই দিবসের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর এবং বাস্তব ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। কারণ, দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে MSME খাত একটি মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে। এই খাত দেশের প্রতিটি অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস এবং নারী ও যুবদের আত্মকর্মসংস্থানে অনন্য অবদান রাখছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭৮ লক্ষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ২৫ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, শিল্পখাতভিত্তিক মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৭ শতাংশই MSME খাত থেকে আসে। এই বিশাল অবদান শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক পরিবর্তনেও এক নতুন গতিপথ সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণের জায়গায় MSME খাত একটি ইতিবাচক ও দৃশ্যমান ভূমিকা রেখেছে, যেখানে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ, যা মোট উদ্যোক্তার ১০ শতাংশের মতো।

রপ্তানিমুখী শিল্পখাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণও বাড়ছে। হস্তশিল্প, পাটপণ্য, চামড়াজাত সামগ্রী, তৈরি পোশাকের সহায়ক শিল্পে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে প্রায় ৫ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এবং এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

তবে এই খাতের সামনে এখনো বহু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রায় ৬০ শতাংশ উদ্যোক্তা এখনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে, যার ফলে তারা ঋণ, প্রশিক্ষণ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় পিছিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের SME Refinance Scheme-এর আওতায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার তহবিল থাকলেও, তা সকল উদ্যোক্তার কাছে পৌঁছাতে পারেনি। করোনা মহামারির সময় সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও, এর কেবল ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ব্যবহার করতে পেরেছেন। এতে বোঝা যায়, বাস্তবায়নে প্রশাসনিক জটিলতা ও তথ্যপ্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এখনও বড় বাধা হয়ে আছে।

তবে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, বাংলাদেশে MSME খাত ধীরে ধীরে ডিজিটাল রূপান্তরের দিকে এগোচ্ছে। 'একশপ', 'আমারপে', 'চালডাল', 'সেবা ডট এক্সওয়াইজেড'-এর মতো প্ল্যাটফর্ম ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল বাজারে প্রবেশে সহায়তা করছে। এসব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা পণ্য প্রচার, অর্ডার ব্যবস্থাপনা এবং অর্থ লেনদেন সহজে পরিচালনা করতে পারছেন। যদিও এই খাতে এখনও প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তার ঘাটতি রয়েছে, তবে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনের অংশ হিসেবে MSME খাতকেও নতুন সম্ভাবনার পথে ধাবিত করা সম্ভব হচ্ছে।

এই বাস্তবতা আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, ২৭ জুন শুধু একটি আনুষ্ঠানিক দিবস নয়; এটি একটি কৌশলগত উপলক্ষ। এই দিনটি উদ্যোক্তাদের সম্মান জানানোর পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। ক্ষুদ্র উদ্যোগ মানেই ছোট চিন্তা নয়—বরং বড় স্বপ্নের শুরু। MSME খাতে যদি যথাযথ সহায়তা, বিনিয়োগ এবং নীতিগত সহযোগিতা প্রদান করা হয়, তাহলে এই খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রধান হাতিয়ার হতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচন, টেকসই উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে এই খাতই হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি।
২৭ জুন পালিত হয় ‘ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা দিবস’, যার আন্তর্জাতিক নাম Micro-, Small and Medium-sized Enterprises Day বা সংক্ষেপে MSME Day। জাতিসংঘ এই দিনটি ঘোষণা করে ২০১৭ সালে, বিশ্বের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে সম্মান জানাতে এবং এই খাতের উন্নয়নে সচেতনতা ও নীতিগত সহায়তা বৃদ্ধির আহ্বান জানাতে।

বিশ্বজুড়ে এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের সংখ্যা প্রায় ৯০ শতাংশ, এবং তারা মোট কর্মসংস্থানের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের জোগান দেয়। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে MSME খাতের ভূমিকা অপরিসীম। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আর্জেন্টিনা এই দিবস প্রস্তাব করে, এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

MSME-এর সংজ্ঞা প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠানের কর্মী সংখ্যা ও বার্ষিক আয় বা মূলধনের ভিত্তিতে একে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়—মাইক্রো, স্মল এবং মিডিয়াম। বাংলাদেশেও এই সংজ্ঞা মানা হয় এবং SME Foundation ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ খাতের দেখভাল করে।

MSME খাত অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিগুলোর একটি। তারা দেশের জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে, শহর ও গ্রাম উভয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং নতুন নতুন পণ্যের উদ্ভাবনেও ভূমিকা রাখে। নারীদের অংশগ্রহণ এই খাতে তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়, যার ফলে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নেও এটি একটি বড় প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই দিনে বিভিন্ন সরকার, ব্যবসায়িক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্যোক্তাদের সম্মাননা প্রদান, সেমিনার আয়োজন, ঋণ সহায়তা ঘোষণা ও নীতিনির্ধারণমূলক আলোচনার আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশেও এই দিনটিকে গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। দেশে প্রায় ৭৮ লক্ষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছে, যারা দেশের জিডিপির এক চতুর্থাংশেরও বেশি অবদান রাখছে এবং প্রায় ৮৭ শতাংশ শিল্পকর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।

যদিও MSME খাতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—যেমন ঋণ প্রাপ্তির জটিলতা, উচ্চ সুদহার, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, বাজারে প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা ও কর সংক্রান্ত জটিলতা। এসব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে MSME খাতের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন সহজ ও দ্রুত ঋণপ্রবাহ, ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার, নারীদের জন্য বিশেষ সহায়তা, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি।

২৭ জুনের এই দিবস উদ্যোক্তাদের সম্মান জানানোর পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বও স্মরণ করিয়ে দেয়। সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহায়তা প্রদান করা হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা হতে পারে একটি জাতির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও টেকসই উন্নয়নের মূল চালক। এটি কেবল উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার দিন নয়, বরং তাদের হাতে বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ তুলে দেওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।