ঢাকা, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

সংকটে শিল্পকারখানা ধুঁকছে

২০২৫ জুন ৩০ ১৬:৪৭:৪৪
সংকটে শিল্পকারখানা ধুঁকছে

মীর আব্দুল আলীম


অর্থনীতির বুক চিরে বাজছে অদৃশ্য রক্তক্ষরণের ঘন্টা। নানা সংকটে শিল্পকারখানা ধুঁকছে। রাষ্ট্রীয় ব্যালান্স শিটে ঘুণ ধরেছে-যেন এক অতল গহ্বর, যেখানে প্রতিদিন গিলে ফেলা হয়েছে জনগণের ঘাম ঝরানো সঞ্চয়। লুণ্ঠনের লালসা, পাচারের পথ-ব্যাংকিং খাতের পাপচক্র ও আমাদের দায়গত পনের বছরে দুই লক্ষ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ‘অদৃশ্য’ হয়েছে। শাসনক্ষমতায় ১৫ বছরের একচ্ছত্র আধিপত্যের পর, আজ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের কাছে আমাদের সবচেয়ে জ্বলন্ত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে-‘কে খেলো সেই দুই লাখ কোটি টাকা?’ আর সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের গোপন ফাইলে হিমশীতল হয়ে লুকিয়ে রয়েছে পাচার হওয়া ১৭ বিলিয়ন ডলার! কেউ বলে ‘অপ্রদর্শিত ঋণ’, কেউ বলে ‘খেলাপি’, কেউ আবার বলে ‘নীতিনির্ধারকদের অনুমোদিত লুণ্ঠন’। যাই বলা হোক, টাকাগুলো এখন আর দেশের ভেতরে নেই। তারা এখন জাকুজি-ভিলা, স্কাইলাইন অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা কানাডার ঠাণ্ডা হাওয়ায় হারিয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি যে মন্তব্য করেছেন-তা যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। “ব্যাংক ব্যবস্থা এখন আর্থিক খোলসে দুর্বল, ভেতরে প্রায় ফাঁকা”-এই বক্তব্য দেশবাসীর আত্মবিশ্বাসে ঘোরলাগা এক ধাক্কা। একদিকে খেলাপি ঋণ, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক লুটপাট-সব মিলিয়ে এই খাত এখন অশুভ আঁধারের কুয়াশায় ঘেরা। আমরা জানি, অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে কেবল কাগজে-কলমে জিডিপির হার দিয়ে তা ঢেকে রাখা যায় না। জনগণের টাকায় বানানো ব্যাংক, জনগণের উপরই যখন বিপদ হয়ে দাঁড়ায়, তখন প্রশ্ন ওঠে-এই ব্যবস্থার রক্ষক কি তার নিজস্ব ভক্ষকে পরিণত হয়েছে?

এই প্রবন্ধে আমরা খোঁজ নেব, ঠিক কীভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থায় দুর্নীতির ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। জানব, কারা এই অর্থ লোপাটের প্রধান রূপকার, কেন এতদিন তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে, আর কীভাবে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের ধারাবাহিকতা থামানো সম্ভব। আমরা অনুসন্ধান করব-এই লুণ্ঠনের পেছনের কাঠামোগত ফাঁক, দুর্বল নীতিমালা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আমরা তুলে ধরব কিছু বাস্তবসম্মত করণীয়-যা কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে নয়, জনগণের হৃদয়ে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে। এই লেখা কোনও একক অভিযোগ নয়, বরং এক সামষ্টিক আত্মসমালোচনার আহ্বান। সময় এসেছে সত্যের মুখোমুখি হবার। এই রাষ্ট্রের টাকা কারা লুটলো-এ প্রশ্ন আর অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।

লোপাট হয়েছে কোথায় কোথায়: অর্থনৈতিক ডাকাতির মানচিত্র

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত যেন এক অদৃশ্য গোলকধাঁধা, যেখানে প্রবেশ আছে, কিন্তু দায় নেওয়ার কোনো দরজা নেই। প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা ব্যবসায়ী, এবং কথিত বিনিয়োগকারীরা-সবাই যেন এক অদৃশ্য চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ভাগ করে নিচ্ছেন জনগণের সঞ্চয়। এসব লুটপাটের রাস্তাগুলো একদিকে খুব চেনা, আবার অন্যদিকে এতটাই জটিলভাবে সাজানো যে একে রীতিমতো আর্থিক অন্ধকারের জাল বলা চলে। প্রথমত, বড় আকারের ভুয়া ঋণ-যা দেওয়া হয় পরিচিত গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এসব ঋণের বিপরীতে নেই সঠিক জামানত, নেই প্রকৃত ব্যবসায়িক কার্যক্রম। আছে শুধু প্রভাব, ফোন কল, এবং দুর্বল ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ। হলমার্ক কেলেঙ্কারি এই দুষ্টচক্রের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে এই গ্রুপটি ভুয়া দলিলের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। ব্যাংকের ভেতরের কর্মকর্তারা তখন কেবল ‘হ্যাঁ স্যার, জ্বী স্যার’ বলেই চোখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তখন এই প্রশ্ন কেউ তোলেনি—একটি কোম্পানি কাগজে কলমে আছে, কিন্তু বাস্তবে কোথায়? এরপর আসে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, যার নাম এখনকার অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ে ‘ব্যাংক ডাকাতির ক্লাসিক কেস’ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত। এ ব্যাংকের ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেই যেন লুটের থলির চাবি হাতে নিয়ে বসেছিলেন। প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকা কীভাবে গেল, কোথায় গেল, কার পকেটে ঢুকল-তা নিয়ে তদন্ত হয়েছে, রিপোর্ট হয়েছে, কিন্তু জবাবদিহি হয়নি।

এছাড়া, মেগা প্রকল্প—যার বাজেট শুনলেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়-তাতেও রয়েছে আরেক রকমের প্রতারণা। প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়, পরে সেই টাকা বিনিয়োগের বদলে চলে যায় অন্য খাতে-জমি কেনা, রাজনীতিককে ম্যানেজ করা কিংবা বিদেশে টাকা পাচার। অন্যদিকে, রপ্তানি বা আমদানির আড়ালে কোটি কোটি ডলার পাচার হয়ে গেছে। কাগজে-কলমে ১০০ কনটেইনার মালামাল দেখানো হয়েছে, অথচ এসেছে মাত্র ১০টা। এই ভুয়া এলসি বা মিথ্যা ইনভয়েসিং আজ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারকে ফাঁপা করে তুলেছে। এইভাবে একের পর এক ব্যাংক জড়িয়ে পড়েছে-চিন্তায় নয়, চুরি করে টিকে থাকার চেষ্টায়। ইসলামী ব্যাংক থেকে শুরু করে ফারমার্স, সিটি, রূপালী, এমনকি কিছু প্রাইভেট ব্যাংকও লোপাটের চোরাবালিতে হেঁটেছে। কেউ জেনেশুনে, কেউ পরিস্থিতির চাপে। সব মিলিয়ে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে একটি ছিদ্র আছে, যেখান দিয়ে লাখো কোটি টাকা পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর এই ছিদ্র কেউ বন্ধ করতে চায় না—কারণ, সবাই জানে এই টাকার গন্ধ ক্ষমতার ঘ্রাণের চেয়েও বেশি মোহময়।

অর্থপাচারে ভারত, পাকিস্তানসহ আশেপাশের দেশের তুলনা: অর্থপাচারের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর পরিস্থিতি তুলনা করলে দেখা যায় যে, ভারত এবং পাকিস্তানেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। ভারতে: ব্যাংকিং খাতে এনপিএ (নন-পারফর্মিং অ্যাসেট) সংকটের কারণে আর্থিক অনিয়মের ঘটনা প্রচুর। বিজয় মালিয়ার পলাতক হওয়া বা নীরব মোদীর আর্থিক কেলেঙ্কারি এ বিষয়টির উদাহরণ। তবে, ভারত কঠোর আইন এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম। পাকিস্তানে: পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি অর্থপাচারের প্রধান কারণ। এখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্বল আর্থিক কাঠামোর কারণে পাচার ঠেকানো সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের চিত্র: বাংলাদেশে অর্থপাচারের হার এবং এর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি। এখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জড়িত থাকার কারণে এই ঘটনা আরও জটিল হয়ে ওঠে।

লুটপাটের অর্থ কিভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব: লোপাট হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে হলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পাশাপাশি কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ১. আন্তর্জাতিক সহায়তা: অর্থ ফেরানোর জন্য জাতিসংঘ, ইন্টারপোল, এবং বিশ্বব্যাংকের "স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি ইনিশিয়েটিভ" এর মতো উদ্যোগগুলোর সহায়তা নিতে হবে। ২. স্থানীয় তদন্ত: পাচারের অর্থের উৎস এবং গন্তব্য সনাক্ত করতে বিশেষজ্ঞ সংস্থা নিয়োগ দিয়ে গভীর তদন্ত পরিচালনা করতে হবে। ৩. সম্পদ জব্দ: পাচারকারীদের সম্পত্তি জব্দ করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

লোপাটে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা: অর্থ লোপাটে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের নামে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণের ঘটনাগুলো প্রায়শই পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংক নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেনি। এমনকি অনেক সময় ক্ষমতাসীন নেতাদের নাম জড়িত থাকায় তদন্ত প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।

কোন পথে সমাধান: রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আর্থিক অনিয়মের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। দলের অভ্যন্তরে আত্মসমালোচনা এবং দুর্নীতিবাজদের দল থেকে বাদ দেওয়ার মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেটা বাংলাদেশে কতটা সম্ভব তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। যারা যখন সুযোগ পায় তারাই লুটপাটে জড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্ণধাররা শক্ত হাতে সততার সাথে চাইলে তার দুর করা সম্ভব।

আমলা ও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা: অর্থ লোপাটের অন্যতম প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন সরকারি আমলারা। ঋণ অনুমোদন, ভুয়া প্রকল্পের অর্থায়ন, এবং পাচারের পথ সহজ করতে সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে অনুমোদিত ঋণের অধিকাংশই সরকারি প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সুপারিশে দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারি কর্মকর্তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং সন্দেহজনক লেনদেনের ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পত্রপত্রিকার ভূমিকা: অর্থ লোপাট ও পাচারের ঘটনায় পত্রপত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গণমাধ্যমের সাহসী প্রতিবেদন অনেক ঘটনাকে জনগণের সামনে নিয়ে এসেছে। তবে, এখনও অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে চাপে ফেলা হয়, এবং তারা সত্য প্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়। গণমাধ্যমকে আরও স্বাধীনতা দেওয়া এবং সত্য প্রকাশে সহায়তা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে, ভুয়া খবর ও প্রোপাগান্ডার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

অর্থপাচারে কারা বেশি সম্পৃক্ত: রাজনীতিবিদ নাকি আমলা?: রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মধ্যে কারা অর্থপাচারে বেশি সম্পৃক্ত, তা নির্ধারণ করা কঠিন। তবে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির সুযোগ বেশি থাকে। অন্যদিকে, আমলারা তাদের অবস্থান এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে পাচারের পথ তৈরি করেন। উভয় পক্ষকে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

অর্থপাচারে পুনরাবৃত্তি চাই না: অর্থপাচারের ঘটনা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। পুরনো ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন, এবং তথ্য আদান-প্রদানে স্বচ্ছতা আনার মাধ্যমে পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব।

পাচার বন্ধে করণীয়: ১. কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ: অর্থপাচার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আইন প্রণয়ন ও তার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ২. দুর্নীতি দমন: দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী ও স্বচ্ছ করতে হবে। ৩. ডিজিটাল নজরদারি: ব্যাংকিং কার্যক্রমে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে নজরদারি বাড়াতে হবে। ৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: পাচারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে তথ্য বিনিময় এবং তদন্ত প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে হবে। ৫. গণসচেতনতা: জনগণকে অর্থপাচারের বিষয়ে সচেতন করা এবং তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

পরিচ্ছন্ন অর্থ সমৃদ্ধ দেশ গড়তে যা এখনই করতে হবে: ১. ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। ২. প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নির্মূল করা। ৩. জবাবদিহিতা বাড়াতে অর্থনৈতিক নীতিমালা সংস্কার। ৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানো। ৫. শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৎ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।

পরিশেষে বলতে চাই- এই দেশ এক সময় রক্ত দিয়ে স্বাধীন হয়েছিল, আজ সে রক্ত কেবল রঙিন পোস্টারে ছাপা হয়। তখন ট্যাঙ্ক, বন্দুক আর বুলেট ছিল শত্রু। এখন শত্রু স্যুট-পরা চেয়ারম্যান, টাই-করা পরিচালক, আর কালো গ্লাসে চা খাওয়া পরামর্শদাতা। ব্যাংক ছিল রাষ্ট্রের হৃদপিণ্ড-সেখান থেকে এখন রক্ত টেনে নেয় একদল অর্থলোভী পিশাচ। হলমার্ক, বেসিক, এস আলম, বিসিআইসি-এই নামগুলো কেবল কেলেঙ্কারির নাম নয়, এগুলো হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন, এ অপরাধে জড়িত রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। যে বিশ্বাসঘাতকতা আজও বিচার পায় না, মুখ পায় না, শাস্তি পায় না। যে টাকা দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ গড়া যেত, সে টাকা আজ কানাডায় বাড়ি বানায়। যে ঋণে কৃষকের জন্য যন্ত্র কেনা যেত, সে ঋণ আজ আরবের মরুভূমিতে বালির উপর হোটেল বানায়। অথচ এই দেশের মানুষ এখনো ভিজে খুপরিতে রাত কাটায়, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মরার অপেক্ষায় থাকে।
আমরা ভাবি, এটা কেবল অর্থনৈতিক সংকট। না, এটা একটি নৈতিক ধস। এই ধস থামাতে হলে দরকার একটা আত্মশুদ্ধির আন্দোলন, যার শুরুটা হবে-নিজের মুখের আয়নায় তাকিয়ে জিজ্ঞেস করার মধ্য দিয়ে: আমি কি শুধুই দর্শক? নাকি আমি-ই সেই মৌন সম্মতিসূচক? এই লুটপাটের দায় একদিন ধূলোর নিচে চাপা পড়বে না। ইতিহাস জানে, কে কখন চুপ ছিল, কে কখন মঞ্চে উঠে কবিতা পড়েছিল, আর কে টাকায় কিনেছিল বিবেকের মৌনতা। এ দেশ একদিন হিসাব চাইবেই।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।