প্রচ্ছদ » কৃষি » বিস্তারিত
সবজি ও ফসলে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ, বাড়ছে পোকার সংক্রমণ, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য
২০২৫ জুলাই ০২ ১৫:৫৭:১২
শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : গ্রীষ্মকালীন টমেটো ক্ষেতে ফলছিদ্রকারী ও অন্যান্য পোকা-মাকড় দমনে স্প্রে করতে পানির সাথে মেশানো হচ্ছে কীটনাশক। কিছুক্ষণ পরেই তা স্প্রে (ছিটানো) করা হচ্ছে ক্ষেতে। পাশেই অন্য ক্ষেতে মাজরা ও লাল পোকা দমনে সারের সাথে কীটনাশক মেশাচ্ছেন একজন কৃষক।
এভাবে পোকা দমনে সবজি ও ফসলে কীটনাশক ব্যবহার করছেন ঝিনাইদহের কৃষকরা; তবে তা মাত্রাতিরিক্ত। এ জেলার কৃষকেরা বছর জুড়েই সবজি উৎপাদন করে থাকেন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সবজির একটি বড় অংশ পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়। কৃষকেরা এতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তবে উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার খাবার টেবিলে পৌঁছানো পর্যন্ত সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে।
নিজেদের ধারনা, দোকানীর পরামর্শ,ঔষধের সঠিক মাত্রা-প্রয়োগ ও নির্দিষ্ট দিনের ব্যবধান না মেনেই ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ করছেন কৃষকরা। খুব কম সংখ্যক কৃষক কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুসরণ করছেন। বেগুন, টমেটো, ধানসহ অন্যান্য সবজি ও ফসলে বিভিন্ন কোম্পানীর আইসোসাইক্লোসেরাম, এবামেকটিন, থায়ামেথোক্সাম, ক্লোরান্টরানিলিপ্রোলসহ নানা গ্রুপের ঔষধ ব্যবহার করছেন কৃষকরা। মানছেন না ফসল তোলার ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধান। ফসলের ক্ষেতে নিয়ম জেনে না জেনে কিংবা নানাভাবে ইচ্ছামত কীটনাশক ব্যবহার করছে তারা। ফলে পোকার মধ্যে কীটনাশকের প্রতিরোধ শক্তি বেড়ে যাওয়াই আগের তুলনায় বাড়ছে সংক্রমণ এবং এর নেতিবাচক প্রভাব জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর পড়ছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাটি,পানি ও বাতাস দূষিত হচ্ছে এবং একইসাথে উৎপাদিত খাদ্যশস্যও বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে কৃষক ও ভোক্তার স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
এদিকে,জেলার পথে পথে কয়েক হাজার দোকান। যে যার মতো করে দোকান খুলে কীটনাশক বিক্রি করছেন। কৃষিবিদের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই নিজেরাই কৃষিবিদ বনে যাচ্ছেন বিক্রেতা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়,বেগুনে ফল,ডোগা ছিদ্রকারী পোকা দমনে আইসোসাইক্লোসেরাম গ্রুপের ঔষধ ১৬ লিটার পানিতে ৯.৬ মিলি ব্যহারের নিয়ম থাকলেও কৃষক ১৬লিটার পানিতে ১৫ মিলি ব্যবহার করছেন। এই কীটনাশক প্রয়োগের অন্তত ১৪ দিন পর সবজি সংগ্রহের কথা থাকলেও কৃষক কয়েকদিন পর পরই সবজি বাজারজাত করছেন।
টমেটোয় ফল ছিদ্রকারী সহ অন্যান্য মাকড় দমনে এবামেকটিন গ্রæপের ঔষধ ১৬ লিটার পানিতে ১৯.২ মিলি ঔষধ মিশিয়ে প্রতি এক শতক জমিতে ২ লিটার পানি স্প্রে করার নিয়ম থাকলেও কৃষক প্রতি ১৬ লিটার পানিতে ১৬ মিলি ঔষধ ব্যবহার করছে। প্রতি ৭ দিন অন্তর ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে। এই ঔষধ শেষ প্রয়োগের অন্তত ২১ দিন পর ফল সংগ্রহ করার নির্দেশনা থাকলেও মাত্র ৭ দিন পর ফল সংগ্রহ করছে কৃষক।
অন্যদিকে বেগুন,শিম,টমেটো সবজিতে ফলছিদ্রকারী পোকা দমনে থায়ামেথোক্সাম গ্রæপের ১৬ লিটার পানিতে ৮ মিলি ঔষধ (প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি ঔষধ) মেশানোর কথা থাকলেও কৃষক ক্ষেতে ১৬ লিটার পানিতে ১৫ মিলি ঔষধ ব্যবহার করছে। অনুমোদিত মাত্রায় এই ঔষধ প্রয়োগ করলে দুই দিন পর বেগুন ও টমেটো সংগ্রহ করা যাবে আর ১৪ দিন পর শিম সংগ্রহ করা যাবে। অন্যদিকে ধানের মাজরা পোকা দমনে ৩৩ শতকের বিঘায় থায়ামেথোক্সাম (২০%) ও ক্লোরান্টরানিলিপ্রোল (২০%) গ্রুপের ঔষধ ১০ গ্রাম গুলিয়ে সারের সাথে মিশিয়ে ধান ক্ষেতে প্রয়োগ করতে হয়। এর কার্যকারিতা ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ স্থায়ী হলেও কৃষক তার ক্ষেতে এক সপ্তাহ অন্তর ব্যবহার করছেন।
চিকিৎসক, কৃষিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে কয়েকটি ক্ষতির কারণ জানিয়েছেন-
স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব : অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাথাব্যথা,শ্বাসকষ্ট,চর্মরোগ এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে কীটনাশক ক্যান্সারের মতো রোগেরও কারণ হতে পারে বলে বলছেন চিকিসকরা।
পরিবেশ দূষণ : কীটনাশক মাটি,পানি ও বাতাসকে দূষিত করছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জলজ প্রাণী, পাখি এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ফসলের উপর প্রভাব : মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ফসলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে এবং নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি : কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষককে বারবার কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, ফলে তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া : কীটনাশক ব্যবহারের ফলে উপকারী পোকামাকড় ও জীবাণু মারা যাচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফসল আবাদের পরিধি ও ধরন এখন বদলে গেছে। বেড়েছে ক্ষতিকর রোগজীবাণু ও কীটপতঙ্গ। এসব দমনে কৃষক বালাইনাশকের ব্যবহারও বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে ফসলে ছত্রাকের আক্রমণ হলে সেটা দমনে এক ধরনের বালাইনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। তাতে সাময়িক সময়ের জন্য ছত্রাক অকার্যকর হয়ে পড়ল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই ছত্রাকই আবার ধরন বদলে ফিরে আসছে। ফলে তখন ওই কীটনাশক আর কাজ করে না। এ প্রক্রিয়াটাকে বলে রেজিস্ট্যান্স। এ বিষয়ে এখনই সচেতন না হলে ভবিষ্যতে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন যেমন হুমকিতে পড়বে,তেমনি বাড়বে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। অবশ্য কৃষি বিভাগ বলছে,এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে তারা।
কথা হয় শৈলকুপা উপজেলার দামুকদিয়া গ্রামের কৃষক মাসুদ মোল্লার সাথে। তিনি বলেন,‘এক মাসের বেশি সময় ধরে মরিচখেতে পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। কয়েক ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করেছি। তিনটি কীটনাশক একসঙ্গে মিশিয়েও প্রয়োগ করা হয়েছে। তাতে কাজ হচ্ছে না। শুধু এর পেছনে গচ্চা দিতে হয়েছে কয়েক হাজার টাকা।’
গত মৌসুমে একই ধরনের ছত্রাকের উপদ্রব দেখা দেয় উপজেলার মাধবপুর গ্রামের কৃষক আবদুল আজিজের শিমখেতে। মৌসুমের শুরুর দিকে ভালোই গাছ গজিয়েছিল। ফুল যেমন এসেছিল,তেমনি শিমের ফলনও ভালো হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে পাতা মোড়ানো রোগ দেখা দেয়। দফায় দফায় কীটনাশক প্রয়োগ করেন। বিক্রেতাদের পরামর্শে কয়েকটি কীটনাশক একসঙ্গে মিশিয়েও প্রয়োগ করেন। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি।
কৃষকেরা কীটনাশকে ক্ষতি ও অতিরিক্ত ব্যবহারের সত্যতা স্বীকার করে বলেন,এসব কীটনাশক প্রয়োগ করলে খেতের আশপাশের নদী,নালা,খাল-বিল এমনকি জলাভ‚মিতে তা ছড়িয়ে পড়ে উদ্ভিদ, সাপ,ব্যাঙ,মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী মারা যায়। তবে আগের তুলনায় পোকার সংক্রমণ বেশী হওয়াই ঘন ঘন কীটনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে বলে জানালেন কৃষকরা।
এদিকে দোকানীরা বলছেন,কৃষকদের ঔষধের গায়ের লেখা ও কোম্পানীর প্রতিনিধির কাছ থেকে শুনে পরামর্শ দিয়ে থাকেন তারা। অনেকক্ষেত্রে কৃষি বিভাগের মানুষের থেকেও পরামর্শ নেন।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর-এ-নবী বলেন,‘কৃষকরা জমিতে কীটনাশক প্রয়োগে কৃষি বিভাগের পরামর্শ মানেন না। ফলে প্রয়োগের মাত্রা ঠিক না থাকায় ওই কীটনাশকের উপর পোকা-মাকড়ের সহনশীলতা বেড়ে যায়। ফলে পোকা দমন হয় না বরং বৃদ্ধি পায়। বালাইনাশক ব্যবহারে কৃষকদের সচেতনতা বাড়াতে মাঠ দিবস পালন করে আসছি আমরা। ভবিষ্যতে কৃষকদের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি বালাইনাশক বিক্রির বিষয়ে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ঝিনাইদহের আঞ্চলিক কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সোনিয়া শারমিন বলেন,‘মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ ও সবজি তোলার মধ্যে নিদ্রিষ্ট সময়ের ব্যবধান না মানলে কীটনাশকের প্রভাব ওই সবজিতে থেকে যেতে পারে। যা স্বাস্থ্য ঝুকি বৃদ্ধি করে। কৃষকের অজ্ঞতার কারণে যত্রতত্র ব্যাপকভাবে বালাইনাশক ব্যবহার হয়ে আসছে। এতে সবজি,ফলের মান ও পুষ্টির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কীটনাশকের প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং আরো গবেষণা চলমান। যেটুকু গবেষণা এরই মধ্যে হয়েছে এতে দেখা গেছে,পুষ্টিগুণের ওপর বেশ প্রভাব পড়েছে। মানহীন বালাইনাশক ব্যবহার ও অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে নারী-পুরুষ উভয়ের বন্ধ্যাত্ব তৈরি হচ্ছে। শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় বাধা সৃষ্টি করছে। ভোক্তা ও কৃষক উভয়ের ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি বাড়ছে। চর্মরোগ ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এখনই এর অতিরিক্ত ব্যবহার ঠেকানো না গেলে অদূরভবিষ্যতে কৃষিতে ভয়াবহতা দেখা দেবে।’
(এসই/এএস/জুলাই ০২, ২০২৫)