প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
হিন্দুরা আর বাংলাদেশে মুসলমানের সাথে একত্রে থাকতে পারবে না?
২০২৫ জুলাই ০২ ১৬:৩২:৩৫
শিতাংশু গুহ
সামাজিক মাধ্যমে ক’দিন আগে আমি একটি পোস্টিং দেই, তাতে লিখি ‘হিন্দুরা আর বাংলাদেশে মুসলমানের সাথে একত্রে থাকতে পারবে না’? এতে বেশ হৈচৈ পড়ে, অনেকেই জানতে চান কেন কি হয়েছে? তাদের বলি, সদ্য ঢাকার খিলক্ষেতে বুলডোজার দিয়ে দুর্গামন্দির ও প্রতিমা গুড়িয়ে দেয়া এবং লালমনিরহাটে ইসলামের নবীর অপমানের মিথ্যা অজুহাতে নাপিত পিতাপুত্রকে প্রকাশ্যে গণপিটুনী দিয়ে পুলিশে হস্তান্তরের পরও কি মনে হয় হিন্দুরা মুসলমানের সাথে থাকতে পারবে? এ দু’টি ঘটনায় সরকার, প্রশাসন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সবাই একযোগে হিন্দুদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। সরকার ও প্রশাসন যখন একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কাজ করে তখন ওই সম্প্রদায় কতক্ষন টিকতে পারে? আর টিকতে না পারলে হিন্দুদের যা করার দরকার তাইতো করতে হবে, তাইনা?
আচ্ছা বলুন, এ দু’টি ঘটনায় কতজন মুসলমান কথা বলেছেন? মুসলিম সম্প্রদায়ের কোন সংগঠন কি বিক্ষোভ করেছেন, সমাবেশ করেছেন? না, করেননি। অনেক ইউ-টিউবার এখন অনেক ইস্যু নিয়ে কথা বলছেন, এঁরা কি কেউ এ দু’টি ইস্যু নিয়ে ‘টকশো’ করেছেন, না করেননি, অন্তত: আমি দেখিনি। না করার অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে, এর একটি কারণ হচ্ছে, হিন্দুদের নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই, হিন্দুরা থাকলো কি গেলো তাতে তাদের কি? সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান কি স্বীকার করে যে বাংলাদেশে হিন্দুরা চরমভাবে অত্যাচারিত? না, করেনা। হ্যাঁ, কিছু মুসলমান আছেন যারা স্বীকার করেন, কিন্তু তাঁরা নীরব, হিন্দুরা ঠাট্টা করে বলে, ‘কবি এখানে নীরব’। ভাববেন না যে, আমি শুধু ড. ইউনুস সরকারের কথা বলছি, বাংলাদেশে হিন্দুদের ক্ষেত্রে সকল সরকারের চরিত্র অভিন্ন।
জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া সরকার সাম্প্রদায়িক। শেখ হাসিনা’র সরকার প্রগতিশীলতার নামে সাম্প্রদায়িক। আজকে বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানের জন্যে শেখ হাসিনা’র সরকার দায়ী। ঐ সময় হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের কথা হিন্দুরা ভুলেনি। শেখ হাসিনা বহুবার বলেছেন, ‘মদিনা সনদে দেশ চলবে’। ড. ইউনুস এখন মদিনা সনদ বাস্তবায়ন করছেন। সেখানে হিন্দুরা থাকে কি করে? তাই আবারো বলছি, বাংলাদেশে হিন্দুরা আর মুসলমানের সাথে থাকতে পারবে না? আসলে মুসলমানরা চাচ্ছেনা হিন্দুরা তাদের সাথে থাকুক? তাই উভয় সম্প্রদায়ের কল্যানে মুসলমান ও অমুসলমান পৃথক থাকুক। মুসলমানরা প্রতিনিয়ত হিন্দুদের মন্দির-মুর্ক্তি ভাঙ্গছে, পূজায় বাধা দিচ্ছে, অর্থাৎ তারা চাচ্ছেনা হিন্দুরা ধর্মকর্ম করুক। হিন্দুরাও এখন আর আগের মত মুসলমানদের আস্থায় নিতে পারছে না?
তাই ঝামেলার কি দরকার, দুই গ্রূপ পৃথক থাকুক। মুসলিম-অমুসলিম, হ্যাঁ সকল অমুসলিম অর্থাৎ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-আদিবাসী-উপজাতি সবাই একসাথে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। হিন্দুরা ঝামেলা চায়না, তাঁরা শান্তিতে থাকতে চায়। সংখ্যাগরিষ্ট শাসক মুসলমানের সাথে অন্যরা থাকতে পারেনা, পুরো পৃথিবী এর প্রমান, বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়? জানি আপনারা বলবেন, এটি ঠিক নয়, যুগযুগ ধরে হিন্দু-মুসলমান একসাথে থেকেছে। কেউ হয়তো বলবেন, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’..। আচ্ছা গত ৭৮ বছর আমরা কি শান্তিতে ছিলাম? এই আগে-টা ঠিক কবে? বাংলাদেশ বা ঐ ভূখণ্ডে হিন্দুরা ৭৮ বছর চেষ্টা করেছে মুসলমানের সাথে একত্রে থাকতে। এর নীট ফলাফল হচ্ছে, হিন্দু প্রায় ২৯.৭% থেকে ৭.৯৫%-এ নেমে এসেছে। প্রতিদিন নাবালিকা জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত হচ্ছে। হিন্দুরা প্রতিদিন লাঞ্ছিত হচ্ছে। ধর্ম পালনে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে দিনাতিপাত করছে।
প্রতিনিয়ত ভয়ের মধ্যে থেকে একটি জাতি বাঁচতে পারেনা। বাংলাদেশের দুই কোটি হিন্দু বাঁচতে চায়, তাই ভয়কে জয় করে উঠে দাঁড়াবে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভু হিন্দুদের কানে কানে সেই মন্ত্র দিয়ে দিয়েছেন। তাই তিনি বিনা বিচারে কারাবন্দী। প্রতিদিন মামলা বাড়ছে। কতজন মুসলমান তাঁর মুক্তি দাবি করেছেন, কতজন কথা বলেছেন? ক’দিন আগে এক বিএনপি হিন্দু নেতার সাথে একান্তে কথা হয়, এক পর্যায়ে তাঁকে প্রশ্ন করি, বাংলাদেশে আপনার নাতি-পুতি’র জন্যে কি ভবিষ্যৎ রেখে যাচ্ছেন? তিনি ভড়কে যান, সত্যিই তো? বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক বা সকল সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের কাছে আমাদের প্রশ্ন, বাংলাদেশের হিন্দুদের ভবিষ্যৎ কি? মুসলমানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল আর হিন্দুর ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন, তা তো চিরদিন হিন্দুরা মেনে নেবেনা? হিন্দুরা ভারতে চলে যাবে? সবাই ধর্মান্তরিত হয়ে যাবে? এই ইন্টারনেট যুগে সেটি আর হচ্ছেনা। হিন্দুরা বাংলাদেশের ভূমিপুত্র, এদেশ ছেড়ে হিন্দুরা কোথাও যাবেনা।
সামাজিক মাধ্যমে আমার পোস্টিং পড়ে আমার বন্ধু আব্দুর রশিদ জেনেভা থেকে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। অতিশয় ভদ্রলোক রশিদভাই একদা জেনেভা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। না, রশিদভাই’র সাথে থাকতে আমাদের কোন আপত্তি নেই, সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশে রশিদভাইদের সংখ্যা অতি নগন্য। রশিদভাই আশাবাদী যে, একদিন বৃহত্তর বাংলায় হিন্দু-মুসলমান একত্রে সুখে-শান্তিতে বিশ্বাস করবে। সেটি হচ্ছেনা রশিদভাই, ‘ন্যাড়া বারবার বেলতলা যায়না’; বাংলাদেশের হিন্দু আপনাদের সাথে থাকার মজা টের পেয়ে গেছে! পশ্চিমবাংলার কিছু ‘কুস্মান্ড’ হিন্দু বৃহত্তর বাংলার কথা বললেও বাংলাদেশের হিন্দুরা সত্যি সত্যি আর মুসলমানের সাথে থাকতে চায়না। বৃহত্তর বাংলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট, সুতরাং– তাহলে কি করা?
‘গ্লোবাল বেঙ্গলী হিন্দু কোয়ালিশন’ ইতিমধ্যে ৩টি প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। (১) অমুসলিমদের জন্যে পৃথক নিরাপত্তা জোন সৃষ্টি করা (২) অমুসলিমদের রক্ষায় জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েন করা (৩) ১৯৪৭ সালে বঙ্গে ‘জনসংখ্যা বিনিময়’ হবার কথা ছিলো, তা হয়নি। ড. ইউনুস ‘রিসেট বাটন’ টিপে দিয়েছেন, অর্থাৎ দেশ ১৯৪৭-এ ফিরে গেছে, তাই এক্ষণে ভারতভাগের আলোকে ভূমিসহ জনসংখ্যা বিনিময় সম্পন্ন করা। হিন্দু মহাজোটের গোবিন্দ প্রামানিক খিলক্ষেত দুর্গামন্দির গুড়িয়ে দেয়ার পর ‘হিন্দুদের জন্যে স্বায়ত্বশাষন’ দাবি করেছেন। কলকাতা থেকে একজন বিমল চক্রবর্তী লিখেছেন: আর কত সহ্য করবেন? আপনারা কি দেশত্যাগে বাধ্য হবেন? ভারত কখনোই আপনাদের জন্য যুদ্ধ করবে না তবে ৭১ এর মত ১কোটি হিন্দু দেশ ত্যাগ করে ভারতে অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিলে কি হবে জানিনা। শুধুমাত্র ইজরায়েল মায়ানমারে ঘাঁটি করে হিন্দুদের জন্য কিছু করে দিতে পারে। আপনারা ইসরাইলের শরণাপন্ন হন না কেন?
আসলে সকল অপশন খোলা আছে। বর্তমান সরকার প্রায়শ: বলছে, ভারতের সাথে চোখে চোখ রেখে তাঁরা কথা বলতে চান। বাংলাদেশের হিন্দুরাও এখন সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের চোখে চোখ রেখে স্পষ্টভাষায় বলতে চায়, আপনারা শান্তিতে থাকুন, আমরাও শান্তিতে থাকি। আসুন আমরা পৃথক থাকি। বাপ্ মরলে ভাই-ভাই পৃথক হয়ে যায়, বাংলাদেশের বাপ মারা গেছে, তাই পৃথক হতে আপত্তি কোথায়? এতে উভয়পক্ষ ভালো থাকবেন। এ লেখা শেষ করার মুহূর্তে কুমিল্লার মুরাদনগরে এক মহিলার ঘরের দরজা ভেঙ্গে কিছু লোক আদিম কায়দায় ধর্ষণ করেছে, শুধু তাই নয় ভিডিও করে তা ছেঁড়ে দিয়েছে। এ ঘটনাটি ‘হালকা’ করার জন্যে নানা রকম গল্প বলা হচ্ছে? লালমনিরহাটে হিন্দু পিতা-পুত্রকে নবী মুহম্মদকে অবমাননার জন্যে বেধড়ক মার্ দিয়ে পুলিশে দেয়া হয়েছে, পুলিশ তৌহিদী জনতার পক্ষে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছে। এরআগে অভয়নগরের ঘটনা টেনে আন্তে চাইনা।
প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে আর কতকাল চলবে? হিন্দুরা অনেকদিন গান্ধীর ‘অহিংসা নীতি’ মেনে সুবোধ বালকের মত সবকিছু মেনে নিয়েছে। সময় পাল্টাচ্ছে, হিন্দুরা সোচ্চার হচ্ছে। প্রতিবাদী হচ্ছে। সামনে হয়তো অত্যাচারীর কালো হাত ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবে। দেয়ালের লেখা পড়ুন। একটি বিড়ালকে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে মারতে চাইলে নিরুপায় হয়ে বিড়ালটি বাঁচার তাগিদে নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে পাল্টা আঘাত করতে বাধ্য হয়। হিন্দুদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, আর পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই, বাঁচতে হলে লড়াই করেই বাঁচতে হবে। বাংলাদেশে যদিও ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করেই বাঁচতে চাই’ শ্লোগানটি বহুল ব্যবহৃত, আসলে সবাই শান্তি চায়। সাধারণ হিন্দু-মুসলমান শান্তি চায়। বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান যখন সম্ভব নয়, তাহলে পৃথক থাকাই কি যুক্তিযুক্ত নয়? তাই বলছিলাম কি, এত নির্যাতন সহ্য করে হিন্দুরা হয়তো আর একত্রে থাকতে চাইবে না?
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।