প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত
সারা বিশ্বে জাতিসংঘের অকার্যকর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের ঝড়
২০২৫ জুলাই ০৪ ১৭:২৯:৩৭
দিলীপ চন্দ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর ১৯৪৫ সালে গঠিত জাতিসংঘের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি। কিন্তু সময়ের প্রবাহে এই মহতী সংস্থাটির ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, গণহত্যা, পরিবেশ বিপর্যয় কিংবা শরণার্থী সংকট— কোনো ক্ষেত্রেই জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। বরং অনেকের চোখে এটি এখন একটি “কাগুজে বাঘ” — আছে, কিন্তু দাঁত নেই।
বিশ্বের নানা সংকটে জাতিসংঘের ব্যর্থতা
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত: দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দমন-পীড়ন চলছে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রতিদিনই মরছে নিরীহ মানুষ। জাতিসংঘ একাধিকবার নিন্দা জানালেও বাস্তব কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। বরং নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কাছে প্রতিবার থমকে গেছে মানবতার সব চিৎকার।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালানোর পর বিশ্বব্যাপী যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলেও জাতিসংঘ শুধু “উদ্বেগ প্রকাশ” করেই দায় সেরেছে। যুদ্ধ থামাতে মধ্যস্থতা বা কার্যকর কূটনৈতিক প্রয়াস ছিল না বললেই চলে।
সুদান, সিরিয়া ও ইয়েমেন সংকট: আফ্রিকার সুদান এবং মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া ও ইয়েমেন বর্তমানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। লাখো মানুষ মারা গেছে, কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু। জাতিসংঘ কেবল খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠাচ্ছে, কিন্তু সংঘাত থামাতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই।
নিরাপত্তা পরিষদ: বড় দেশগুলোর হাতের পুতুল?
জাতিসংঘের সবচেয়ে শক্তিশালী অঙ্গ ‘নিরাপত্তা পরিষদ’, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের রয়েছে ভেটো ক্ষমতা। এর মানে তারা চাইলে যে কোনো প্রস্তাব বাতিল করতে পারে। ফলে, বাস্তব ক্ষেত্রে বড় শক্তিধর দেশগুলোর স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হয় না। এ কারণে জাতিসংঘ দিন দিন কার্যকারিতা হারাচ্ছে।
উন্নয়ন, পরিবেশ, মানবাধিকারেও প্রশ্ন
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) বাস্তবায়নে অসংখ্য সম্মেলন, পরিকল্পনা হলেও দরিদ্র দেশগুলো এখনো ন্যূনতম সেবাও পায় না।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বড় বড় সভা-সেমিনার হলেও কার্বন নিঃসরণ কমাতে শিল্পোন্নত দেশগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না। জাতিসংঘ কেবল “সংবেদনশীল আহ্বান” জানিয়ে দায় সারছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় বড় দেশগুলোর বিরুদ্ধে জাতিসংঘ প্রায় নীরব। ছোট দেশ হলে কড়া ভাষার নিন্দা জারি করে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. রামন ভেগা বলেন, “জাতিসংঘ আজ একটি রাজনৈতিক ফাঁদে বন্দী। এর কার্যক্ষমতা কেবল তখনই দেখা যায়, যখন কোনো বড় শক্তির স্বার্থ জড়িত থাকে না।”
পরিশেষে বলা যায় যে, জাতিসংঘের মত একটি বিশ্বসংস্থা যদি যুদ্ধ-গণহত্যা-মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো সংকটে কার্যকর না হয়, তাহলে এর অস্তিত্ব কিসে? নামেই কি কেবল জাতিসংঘ, নাকি এখন সময় এসেছে এর কাঠামোগত সংস্কার ও দায়বদ্ধতার নতুন সংজ্ঞা দেওয়ার?
বিশ্ববাসী আজ প্রশ্ন করছে— “জাতিসংঘ কি মানবতার রক্ষক, না কূটনৈতিক নাটকের মঞ্চ?”
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।