প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
ডিজিটাল যুগে সংবাদপত্র শিল্পের অস্তিত্ব সংকট
টিকে থাকতে ধুঁকছে ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যমগুলো, সরকারি বিজ্ঞাপনই শেষ ভরসা
২০২৫ জুলাই ০৯ ১৯:১৩:৫৫
দিলীপ চন্দ
একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বিপ্লব ও পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র শিল্প আজ এক ভয়াবহ অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। পাঠকসংখ্যা কমে যাওয়া, বিজ্ঞাপন আয়ের পতন, এবং ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয়—এই ত্রিমুখী চাপে সংবাদপত্রগুলো টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে। এর উপর সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা এবং সেই নির্ভরতার প্রতিদান না মেলায় এই শিল্প এখন এক গভীর অনিশ্চয়তার মুখে।
কাগজ-কলমের সীমাবদ্ধতা ও ডিজিটাল রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি তালিকাভুক্ত পত্রিকার সংখ্যা কাগজে-কলমে ৫০০ ছাড়িয়ে গেলেও, এর একটি বড় অংশ কেবল নামসর্বস্ব। প্রকৃতপক্ষে সক্রিয় পত্রিকার সংখ্যা আরও কম। ডিজিটাল মাধ্যমের দ্রুত প্রসারের ফলে পাঠকরা এখন খবরের জন্য সংবাদপত্র নয়, বরং অনলাইন পোর্টাল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ভিডিও প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছেন। এই ডিজিটাল রূপান্তরের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারার কারণে ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্রগুলো পাঠক হারাচ্ছে এবং বিজ্ঞাপনদাতারাও ডিজিটাল মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে।
সরকারি বিজ্ঞাপনের অনিশ্চিত নির্ভরশীলতা
এক দশক আগেও সরকারি বিজ্ঞাপন ছিল সংবাদপত্রগুলোর আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই বিজ্ঞাপনের পরিমাণ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে। এর পাশাপাশি, সরকারি বিজ্ঞাপনের হারও বর্তমান বাজার মূল্যের তুলনায় অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, একটি পূর্ণ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপনের জন্য সরকার যেখানে মাত্র ১৫-২০ হাজার টাকা দেয়, সেখানে একটি পত্রিকার প্রকাশনা ব্যয় এর চেয়ে অনেক বেশি। এই মূল্য ২০১৪ সাল থেকে বাড়ানো হয়নি, ফলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয় এখন প্রায় লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাংবাদিক ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি) জানিয়েছে যে, তালিকাভুক্ত সংবাদপত্রের মধ্যে অনেকগুলোই সরকারি বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভরশীল। যখন এই বিজ্ঞাপন কমে যায়, তখন তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি আকারের পত্রিকাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ তাদের আয় সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপরই বেশি নির্ভরশীল। অনেক জেলায় এখন আর কোনো স্থানীয় পত্রিকা প্রকাশিত হয় না, যা স্থানীয় সংবাদ এবং তথ্যের প্রবাহে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি করছে।
ক্রমবর্ধমান ব্যয় ও আয়ের সংকোচন: এক দুষ্টচক্র
আন্তর্জাতিক বাজারে নিউজপ্রিন্ট, কালি, প্লেট ইত্যাদির দাম বাড়ার কারণে পত্রিকার উৎপাদন ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। পরিবহন খরচ, বিদ্যুৎ বিল এবং কর্মীদের বেতন বৃদ্ধিও এই ব্যয়কে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অন্যদিকে, পাঠকের কাছে পত্রিকার বিক্রয়মূল্য দীর্ঘ দিন ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে লাভের মার্জিন কমে যাচ্ছে এবং অনেক পত্রিকা ক্ষতির মুখে পড়ছে। মালিকরা জানিয়েছেন, এক কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান দিয়েও তাদের পত্রিকা চালাতে হচ্ছে।
ভবিষ্যতের পথ: ডিজিটাল রূপান্তর ও সরকারি নীতি সহায়তা
সংবাদপত্র শিল্পের এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ডিজিটাল রূপান্তর এবং সরকারি নীতি সহায়তা উভয়ই জরুরি।
* ডিজিটাল রূপান্তর: সংবাদপত্রগুলোকে কেবল কাগজের উপর নির্ভরশীল না থেকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজেদের উপস্থিতি জোরদার করতে হবে। অনলাইন নিউজ পোর্টাল, মোবাইল অ্যাপ, সোশ্যাল মিডিয়া এবং মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট তৈরিতে বিনিয়োগ করতে হবে।
* আয়ের বহুমুখীকরণ: শুধু বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর না করে সাবস্ক্রিপশন মডেল, ই-পেপার বিক্রি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক উদ্যোগের মাধ্যমে আয়ের নতুন পথ খুঁজতে হবে।
* সরকারি নীতি সহায়তা: বিজ্ঞাপন মূল্য পুনর্বিবেচনা: সরকারি বিজ্ঞাপনের মূল্য বর্তমান বাজার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা উচিত এবং নিয়মিতভাবে এটি পর্যালোচনা ও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
* প্রনোদনা ও সহজ ঋণ: সংকটাপন্ন সংবাদপত্রগুলোর জন্য সরকার বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ এবং সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে।
* নীতিগত সহায়তা: সংবাদপত্র শিল্পের কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের ব্যবস্থা করা, এবং ডিজিটাল রূপান্তরে সহায়তা করার জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করা।
গণমাধ্যম, বিশেষ করে সংবাদপত্র, একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অপরিহার্য। এটি শুধু খবর সরবরাহ করে না, বরং জনমত গঠন, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং নাগরিক অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই শিল্পের পতন হলে সমাজে তথ্য প্রবাহে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হবে, যা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। তাই, এই শিল্পের আধুনিকীকরণ এবং টিকে থাকার জন্য সরকার, মালিক এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।