ঢাকা, শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫, ৮ ভাদ্র ১৪৩২

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

ইন্দো-প্যাসিফিকের দাবার বোর্ডে বাংলাদেশ: চাপ নয়, চাই সুযোগের সদ্ব্যবহার

২০২৫ আগস্ট ২০ ১৮:২৫:০৩
ইন্দো-প্যাসিফিকের দাবার বোর্ডে বাংলাদেশ: চাপ নয়, চাই সুযোগের সদ্ব্যবহার

ইমদাদুল হক সোহাগ


একদা বঙ্গোপসাগর ছিল দক্ষিণ এশিয়ার শান্ত এক জলরাশি, যার পরিচিতি ছিল মূলত মৎস্য আহরণ ও বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু সে যুগ পাল্টেছে। আজকের বঙ্গোপসাগর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার এক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন, ভারত থেকে জাপান—প্রত্যেকেই নিজ প্রভাব বলয় বিস্তারে তৎপর। এই জটিল সমীকরণের কেন্দ্রেই বাংলাদেশের অবস্থান, যার আশীর্বাদস্বরূপ ভৌগোলিক অবস্থানটিই এখন বহুমুখী চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির হাতছানি, অন্যদিকে বৃহৎ শক্তিগুলোর কৌশলগত টানাপোড়েনে নিজের সার্বভৌমত্ব ও স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ণ রাখার এক কঠিন পরীক্ষা। বাংলাদেশের সামনে এখন একমাত্র পথ হলো—এই উত্তাল সমুদ্রে বিচক্ষণতার সাথে নিজের গতিপথ নির্ধারণ করা, চাপকে কৌশলে মোকাবিলা করা এবং অপার সুযোগকে জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগানো।

ভূরাজনৈতিক সমীকরণ ও বাংলাদেশের অবস্থান

বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থান একই সঙ্গে এর শক্তি ও দুর্বলতা। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কৌশলগত প্রতিযোগিতার মূল মঞ্চে অবস্থান করছে। এই অঞ্চলের প্রধান শক্তিগুলোর উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা ভিন্নমুখী:

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা: ওয়াশিংটনের "মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক" (FOIP) নীতির মূল লক্ষ্য চীনের প্রভাব সীমিত করে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা। কোয়াড (QUAD) জোটের মাধ্যমে তারা এই অঞ্চলে নিরাপত্তার একটি কাঠামো তৈরির প্রয়াসে লিপ্ত, যেখানে বাংলাদেশকে তারা একটি অপরিহার্য অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে।

চীন: বেইজিং তার নিজস্ব "বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ" (BRI)-এর আওতায় এ অঞ্চলের দেশগুলোকে বিশাল অবকাঠামো প্রকল্পে যুক্ত করতে আগ্রহী। গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র—চীনের বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো আকর্ষণীয় হলেও এর সঙ্গে প্রায়শই "ঋণের ফাঁদ" ও কৌশলগত নির্ভরশীলতার ঝুঁকি জড়িয়ে থাকে।

ভারত: দিল্লির "নেইবারহুড ফার্স্ট" এবং "সাগর (SAGAR)" নীতির মূল স্তম্ভ বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরে চীনের বেইজিংয়ের উপস্থিতি ভারতের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের অন্যতম কারণ। তাই ভারত চায়, এ অঞ্চলে নিরাপত্তা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে তার ভূমিকাই যেন মুখ্য থাকে।

জাপান: টোকিও চীনের BRI-এর বিকল্প হিসেবে "গুণগত অবকাঠামো" বিনির্মাণে মনোযোগী। জাপানের "বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট" (BIG-B) উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশ, যার অধীনে বাস্তবায়িত মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এ অঞ্চলের বাণিজ্য মানচিত্র বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা রাখে।

এই চতুর্মুখী চাপের মধ্যে ঢাকার কৌশল হতে হবে অত্যন্ত পরিণত—কোনো নির্দিষ্ট বলয়ে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে সকলের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ ও взаимовыгодный সম্পর্ক বজায় রাখা। এটিই হবে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি—"সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়"—এর একবিংশ শতাব্দীর প্রায়োগিক রূপ, যা আজ "কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন" (Strategic Autonomy) হিসেবে পরিচিত।
অ-জোট নীতির অগ্নিপরীক্ষা

ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ। কিন্তু আজকের বিশ্বে নিষ্ক্রিয় নিরপেক্ষতার কোনো সুযোগ নেই। বরং সক্রিয় নিরপেক্ষতার মাধ্যমে নিজের স্বার্থ আদায় করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু কূটনৈতিক বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ না থেকে বন্দর ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো প্রকল্পে অংশীদারিত্ব, সমুদ্র নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক সংযোগের মতো বাস্তব ক্ষেত্রে এই স্বায়ত্তশাসনের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। অন্যথায়, বাংলাদেশের অ-জোট নীতি একটি 'কাগুজে বাঘ' হিসেবেই পরিগণিত হবে।

বন্দর, সংযোগ ও অর্থনীতির কূটনীতি

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এর বন্দরগুলো। বিশেষত, জাপানের সহায়তায় নির্মিতব্য মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর তার ১৮.৫ মিটার গভীরতার কারণে এ অঞ্চলের 'গেম চেঞ্জার' হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রাখে। এটি কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, নেপাল ও ভুটানের জন্যেও সমুদ্রপথে এক নতুন প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করবে। তবে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের দৃষ্টান্ত এক কঠোর সতর্কবার্তা। তাই বন্দরের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে নিজেদের হাতে রেখে পরিচালনার জন্য উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

একইভাবে, আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক লাভের পাশাপাশি কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এক বিরাট সুযোগ। ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের জন্য ট্রানজিট সুবিধা বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের বাণিজ্যের হৃৎপিণ্ডে পরিণত করবে। তবে এর পূর্ণ সুফল পেতে হলে প্রয়োজন শুল্ক ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং "লাস্ট মাইল কানেকটিভিটি" নিশ্চিত করা। সংযোগকে অর্থনৈতিক প্রকল্পের ঊর্ধ্বে একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

পরিবেশগত নিরাপত্তা ও সুনীল অর্থনীতি

ইন্দো-প্যাসিফিকের আলোচনায় প্রায়শই উপেক্ষিত হয় পরিবেশগত নিরাপত্তার বিষয়টি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের জন্য সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোন ও লবণাক্ততা এক কঠোর বাস্তবতা। অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরের সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি মৎস্য, খনিজ ও অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদে ভরপুর, যা হতে পারে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির সোপান। সমুদ্র দূষণ রোধ, অবৈধ মৎস্য আহরণ বন্ধ এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। এটি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে বাংলাদেশ সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ নিতে পারে।

নীতিগত অগ্রাধিকার

ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে বাংলাদেশকে কয়েকটি নীতিগত বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে:

১. সক্ষমতা বৃদ্ধি: মাতারবাড়ী বন্দরের নির্মাণকাজ দ্রুত সম্পন্ন করে এর ব্যবস্থাপনায় একটি আন্তর্জাতিক মানের পেশাদার কর্তৃপক্ষ গঠন এবং কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ডিজিটাল করা।

২. অর্থায়নের বহুমুখীকরণ: বৃহৎ প্রকল্পগুলোতে কোনো একক উৎসের ওপর নির্ভর না করে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, ইইউসহ একাধিক উৎস থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত করা।

৩. সমন্বিত সমুদ্র নিরাপত্তা: নিজস্ব নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে আধুনিক করার পাশাপাশি আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে তথ্য বিনিময় ও সমন্বিত টহলের মাধ্যমে সমুদ্রসীমাকে সুরক্ষিত রাখা।

৪. সক্রিয় কূটনীতি: বিমসটেক ও আইওআরএ-র মতো আঞ্চলিক ফোরামগুলোকে আনুষ্ঠানিকতার ঊর্ধ্বে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন, সুনীল অর্থনীতি ও কানেকটিভিটির মতো বিষয়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগের চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

বঙ্গোপসাগর আজ বিশ্বশক্তির এক গতিশীল প্রতিযোগিতার মঞ্চ, এবং বাংলাদেশ এর অন্যতম প্রধান কুশীলব। প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও প্রকল্পকে অর্থনৈতিক লাভের পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক প্রভাবের মানদণ্ডে বিচার করতে হবে। নিষ্ক্রিয়তা বা কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়া—দুটিই বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। পথ একটিই—সক্রিয়, বিচক্ষণ ও ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। বিশ্বজুড়ে তৈরি হওয়া অপার সম্ভাবনাকে দুহাতে স্বাগত জানাতে হবে, কিন্তু সেই সম্ভাবনার রাশ বা নিয়ন্ত্রণ সর্বদা রাখতে হবে ঢাকারই হাতে।

লেখক : কলামিস্ট ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক।