প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
শিশুর বিকাশ নিশ্চিত করতে টেকসই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ
২০২৫ নভেম্বর ১৮ ১৭:৪৩:০৪
ওয়াজেদুর রহমান কনক
বিশ্ব শিশু দিবসের গুরুত্ব এমন এক বিস্তৃত মানবিক ও নীতিগত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, যেখানে শিশুদের জীবনের প্রতিটি মাত্রা—অধিকার, নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অংশগ্রহণ, পরিচর্যা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা—একটি সমন্বিত মূল্যবোধের কাঠামোতে বিবেচিত হয়। ২০ নভেম্বরের এই দিবসটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শিশুদের অবস্থান ও মর্যাদাকে শুধু মানবিক অভিভাবকত্বের দৃষ্টিতে নয়, বরং স্বতন্ত্র অধিকারধারী হিসেবে স্বীকৃতির সংকল্পরেখায় প্রতিষ্ঠিত করে। জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে এই তারিখে শিশু অধিকার কনভেনশন (CRC) গৃহীত করার মাধ্যমে যে বৈপ্লবিক ধারার সূচনা করে, তার সঙ্গে এক গভীর রাজনৈতিক-নৈতিক অঙ্গীকার জড়িয়ে থাকে—বিশ্বের প্রতিটি শিশুকে এমন একটি পরিবেশে বড় করে তোলা যেখানে তাদের শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক ও সামাজিক বিকাশের পূর্ণ সুযোগ থাকবে এবং যেখানে তাদের পরিচয়, অনুভূতি ও কণ্ঠস্বরকে সম্মান করা হবে।
বিশ্ব শিশু দিবসের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয় যখন আমরা শিশুদের বাস্তব পরিস্থিতি ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে তাকাই। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, নিরাপদ স্যানিটেশন ঘাটতি, গুণগত শিক্ষার অভাব, সশস্ত্র সংঘাত, শরণার্থী সংকট, শিশুশ্রম, মানবপাচার, জলবায়ু পরিবর্তন ও ডিজিটাল ঝুঁকি—সবগুলোই শিশুদের ওপর অস্বাভাবিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে। শিশুদের এই ঝুঁকিগুলো কেবল সামাজিক বা অর্থনৈতিক অসাম্য নয়; এগুলো মানবাধিকারের মৌলিক প্রশ্ন। ফলে এই দিবসটি রাষ্ট্র, সমাজ ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি এক নৈতিক সতর্কবার্তা—শিশুদের অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতি শুধু ঘোষণায় নয়; বাস্তব নীতি, বাজেট, সুরক্ষা কাঠামো এবং সামাজিক আচরণ বদলের মধ্য দিয়েই তা কার্যকর হতে পারে।
গবেষণা ও জননীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব শিশু দিবস একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম, যেখানে প্রজন্মান্তরের বিনিয়োগ (intergenerational investment) এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের মূলভিত্তি হিসেবে শিশুদের স্থাপন করা হয়। আজকের পৃথিবীতে শিশুর জীবনের প্রথম পাঁচ বছরের স্নায়বিক বিকাশ, প্রারম্ভিক শিক্ষার মান, মনোসামাজিক নিরাপত্তা, পুষ্টি এবং পরিবেশগত সুরক্ষা—সবই দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় সক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ফলে এই দিবসটি শুধু প্রতীকী অনুষঙ্গ নয়; এটি এমন একটি গভীর উন্নয়ন–দর্শনকে সামনে আনে যেখানে শিশুর কল্যাণকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের কেন্দ্রবিন্দু করা অপরিহার্য।
এভাবে বিশ্ব শিশু দিবস মানবিকতা, অধিকার, বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রনীতির যুগপৎ সমন্বয়ে উঠে আসে—একটি এমন আন্তর্জাতিক দিন হিসেবে, যা মনে করিয়ে দেয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কতটা আমাদের আজকের সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ববোধের ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব শিশু দিবসের গুরুত্ব এমন এক বহুমাত্রিক বাস্তবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন, সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য ও মানবাধিকার—সবগুলো ক্ষেত্রই একইসঙ্গে শিশুদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ফলে ২০ নভেম্বরের এই দিনটি কেবল সচেতনতার আনুষ্ঠানিক অনুশীলন নয়; বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যত জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রগঠনের জন্য এক ধরনের নীতিগত প্রতিশ্রুতির পুনর্গঠন। শিশুদের কেন্দ্র করে যেসব বৈষম্য, সম্ভাবনা ও ঝুঁকি একই সঙ্গে কার্যকর থাকে, বিশ্ব শিশু দিবস তার মধ্যেই একটি সমন্বিত আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করে, যার বৈজ্ঞানিক ও নীতিগত গুরুত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যাগত কাঠামো শিশুদের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট করে তোলে। জনমিতি অনুসারে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই শিশু ও কিশোর; তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা ও বিকাশের যথাযথ নিশ্চয়তা ছাড়া রাষ্ট্রের মানবসম্পদ প্রস্তুতই অসম্ভব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিবর্তন, গ্রামগঞ্জ থেকে শহরে ব্যাপক অভিবাসন, শিল্পায়ন, প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, এবং সমাজের স্তরবিন্যাসের পরিবর্তন—এসবই শিশুদের জীবনে নতুন সুযোগের পাশাপাশি নতুন সংকটও সৃষ্টি করেছে। শহরাঞ্চলে ভিন্ন মাত্রার চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান—বস্তিবাসী শিশুদের নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, স্কুলে উপস্থিতি, পুষ্টি, এবং নির্যাতন থেকে সুরক্ষা এখনও কাঙ্ক্ষিত নয়; অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। বিশ্ব শিশু দিবস ঠিক এপ্রেক্ষাপটে স্মরণ করিয়ে দেয় যে জাতীয় উন্নয়ন কেবল অবকাঠামোগত অগ্রগতি নয়—বরং মানবমনে, বিশেষ করে শিশুর মনে বিনিয়োগের মধ্য দিয়েই টেকসই হতে পারে।
বাংলাদেশের নীতিগত বাস্তবতায় শিশু অধিকার কনভেনশন (CRC)-এর স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে যে দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে তা বিশ্ব শিশু দিবসের আলোচনাকে আরও গভীর করে তোলে। যদিও দেশে শিশু সুরক্ষা আইন, জাতীয় শিশু নীতি, এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। আইনি কাঠামো যথেষ্ট হলেও বিচারপ্রক্রিয়ার গতি, শিশু আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি, শিশুবান্ধব পুলিশিং, বিশেষ বরাদ্দ ও মনিটরিং—এসব ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত পরিপক্বতা অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে বিদ্যমান প্রথাগত ধারণা—যেখানে শিশুকে এখনো প্রাপ্তবয়স্কদের ‘অনুগত’ সদস্য হিসেবে দেখা হয়—এটিও তাদের সিদ্ধান্তগ্রহণ বা অংশগ্রহণ সীমিত করে। বিশ্ব শিশু দিবস তাই শিশুদের স্বতন্ত্র অধিকারধারী সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সাংস্কৃতিক ও নৈতিক প্রয়োজনটিকে নতুনভাবে তুলে ধরে।
শিশুশ্রম বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে—যেমন ক্ষুদ্র কারখানা, কৃষিকাজ, দোকান, রিকশা-মেরামত কেন্দ্র বা গার্মেন্টসের উপশাখা—শিশুশ্রম এখনও একটি উদ্বেগজনক চিত্র। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, পরিবারিক চাপ এবং শিক্ষার ব্যয় শিশুদের শ্রমবাজারে ঠেলে দেয়, যেখানে তারা শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক ঝুঁকির মুখে পড়ে। বিশ্ব শিশু দিবস এই চর্চাকে শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে নয়, বরং জাতীয় উন্নয়ন ও তরুণ মানবসম্পদ গঠনের পথে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। একইসঙ্গে এটি সরকার, উন্নয়ন সংস্থা ও নাগরিক সমাজকে শৈশবের মৌলিক সুরক্ষা এবং শিশুর শিক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের শিশুদের ওপর আরেকটি বিশেষ প্রভাব ফেলে। ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা—এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বড় সংখ্যক পরিবারের বাসস্থান ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুদের শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়, অপুষ্টি বৃদ্ধি পায়, মানসিক চাপ ও ট্রমা তৈরি হয়, এবং শিশুবিবাহসহ বহু সামাজিক ঝুঁকি বাড়ে। জলবায়ু-প্রবণ অঞ্চলের শিশুরা বাস্তবে দ্বিগুণ বৈষম্যের মুখোমুখি—একদিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে পরিবেশগত ঝুঁকি। বিশ্ব শিশু দিবস এই কাঠামোটি বোঝায় যে পরিবেশগত ন্যায় ও শিশু অধিকার পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; বরং একটির সুরক্ষা অন্যটির জন্য অপরিহার্য।
শিশুদের ডিজিটাল নিরাপত্তা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তুলনামূলক নতুন কিন্তু অত্যন্ত গুরুতর একটি চ্যালেঞ্জ। ইন্টারনেট ব্যবহারের দ্রুত সম্প্রসারণ শিশুদের শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সুযোগ তৈরি করেছে, তবে একইসঙ্গে সাইবার বুলিং, অনলাইন গ্রুমিং, ভুয়া তথ্য, পর্নোগ্রাফি ও ডেটা নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশ্ব শিশু দিবস এই জটিল বাস্তবতায় ডিজিটাল সিটিজেনশিপ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও শিশুবান্ধব প্রযুক্তিনীতির গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ ছাড়া বাংলাদেশে শিশুদের রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্র থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন রাখার একটি সাংস্কৃতিক বাস্তবতা রয়েছে। শিশুদের মতামত, অংশগ্রহণ এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণে তাদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দেয়া—এই চিন্তাটি এখনও প্রতিষ্ঠানগতভাবে গৃহীত হয়নি। বিশ্ব শিশু দিবস এ জায়গায় এক ধরনের নৈতিক চাপ তৈরি করে—নীতিনির্ধারণে শিশুদের অন্তর্ভুক্তি কেবল মানবাধিকার নয়, বরং স্মার্ট, অংশগ্রহণমূলক ও টেকসই প্রশাসনের অন্যতম শর্ত।
সার্বিকভাবে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব শিশু দিবস জাতীয় উন্নয়ন, নীতি-সংস্কার, সামাজিক ন্যায়, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এবং জলবায়ু-সংবেদনশীল ভবিষ্যৎ নির্মাণের একটি কেন্দ্রীয় দিক। শিশুদের সুরক্ষা এবং তাদের সম্ভাবনা বিকাশকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে না আনলে দেশের দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতি কেবলই ভঙ্গুর থেকে যাবে। তাই বিশ্ব শিশু দিবস গণসচেতনতার একটি দিন থেকে অনেক বেশি—এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রতিশ্রুতিশীল একটি পথনকশা নির্দেশ করে।
বিশ্ব শিশু দিবস (World Children’s Day)—শক্তিপূর্ণ প্রতীক ও নীতিগত চিহ্ন বিশ্ব শিশু দিবস প্রতি বছর ২০ নভেম্বর পালিত হয়; এটি শিশুদের অধিকার, কল্যাণ ও নিরাপত্তার দিকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আহ্বান করে এমন একটি বহুবচক প্রতীক। ২০ নভেম্বরের তাৎপর্য কেবলই স্মরণীয় আয়োজন নয়; এই তারিখটিই আন্তর্জাতিকভাবে শিশু অধিকার নিয়ে ব্যাপক নীতিগত অনিশ্চয়তার এক মিলনবিন্দু, কারণ এ দিনই ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে শিশু অধিকার কনভেনশন (Convention on the Rights of the Child — CRC) গৃহীত হয়। ফলে বিশ্ব শিশু দিবসকে অনেকে ‘শিশু অধিকার দিবস’ হিসেবেও ধরে—এর মাধ্যমে কেবল শিশুদের মৌলিক চাহিদা নয়, বরং তাদের অধিকারগত মর্যাদা, অংশগ্রহণ ও কণ্ঠস্বরকেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ইতিহাসিক ও বিধানগত প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, CRC মানবাধিকার ক্ষেত্রের সবচেয়ে ব্যাপক স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর মধ্যেই দাঁড়ায়; এটি শিশুদের জীবন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা এবং পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে উন্নত করার জন্য রাষ্ট্রগুলোর মৌলিক দায়িত্ব নির্ধারণ করে। CRC-এর ধারণা অনুযায়ী সন্তানকে শুধু সচেতন পুষ্টি বা শিক্ষা প্রাপক হিসেবে নয়, বরং স্বতন্ত্র ব্যক্তি ও অধিকারধারী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে—যার মধ্যে ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ (best interests of the child), ‘কণ্ঠস্বরপ্রকাশের অধিকার’ (participation), এবং বৈষম্যহীনতা (non-discrimination) মূল নীতিগুলো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। CRC-এর সম্পূরক প্রটোকলগুলো (optional protocols) আরও নির্দিষ্ট ঝুঁকি—যেমন সশস্ত্র সংঘাতে শিশুদের অংশগ্রহণ, শিশু বিক্রয় ও যৌনব্যবহার ইত্যাদি—নিয়ন্ত্রণে কাজ করে; এসব প্রটোকল বাস্তবায়ন সত্যিই নিশ্চিন্ত ও সুরক্ষিত জীবন নিশ্চিত করতে অপরিহার্য।
বিশ্ব শিশু দিবসের প্রাসঙ্গিকতা যুগান্তকারী ভূমিকায় দাঁড়ায় যখন আমরা শিশুদের বর্তমান বাস্তবতা ও বহুমাত্রিক সংকটগুলো মূল্যায়ন করি। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল বিশ্বে শিশুরা খাদ্যনির্ভরতা, স্থায়ী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ভোক্তা ও পরিবেশজনিত ঝুঁকি, যক্ষ্মা-রোধ, মাতৃমৃত্যু এবং শিশুযৌবনের মতো জটিল সমস্যার সম্মুখীন। অতি সাম্প্রতিক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো—যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন ও উদ্বাস্তুতা, مسবৎকর অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং সশস্ত্র সংঘাত—শিশুদের উপর অসামান্য ক্ষত তৈরি করেছে: শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্নতা, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি এবং শিশুশ্রম ও মানবপাচারের ঝুঁকি বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব শিশু দিবস একটি সমবেত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে—বিশ্বব্যাপী সরকার, রাষ্ট্রীয় সংস্থা, বেসরকারি সেক্টর, সিভিল সোসাইটি ও শিশু-জোটগুলোকে নीतিগত প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করতে, বাজেট বরাদ্দে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে এবং বাস্তবায়নযোগ্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে অনুপ্রাণিত করে।
নীতিগত প্রয়োগ ও বাস্তবায়নমুখী কাঠামো যে-রকম হওয়া উচিত—তাতে প্রাধান্য থাকবে একটি শিশুকেন্দ্রিক (child-centred) দৃষ্টিভঙ্গি এবং অধিকারভিত্তিক পদ্ধতি। অর্থনীতিতে শিশুর অধিকার বাস্তবায়িত করতে রাষ্ট্রকে অবশ্যই ন্যায্য বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে; সামাজিক সুরক্ষা নীতিগুলো সুষমভাবে শিশুদের লক্ষ্য করে নকশা করা জরুরি, যাতে গরীব পরিবার, অভড়িত-অস্বাভাবিক পরিবারের সন্তান, সংখ্যালঘু বা প্রতিবন্ধী শিশুরা থেকে না যায়। শিক্ষা নীতিতে শুধু নামমাত্র ভর্তিই যথেষ্ট নয়—গুণমানহীনতা নিরসন, বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ, লিঙ্গ সমতা, এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ শিক্ষণপদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যসেবায় টিকার রুটিন, পুষ্টি হস্তক্ষেপ, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং জটিল সমন্বিত যত্ন দেওয়া প্রয়োজন। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থার শক্তিকরণ, শিশুশ্রম বন্ধ, frühen বিয়ে প্রতিরোধ এবং মানুষ পাচার প্রতিরোধে কার্যকর কোর্ট-সাপোর্ট চালানো নির্ধারক।
তদুপরি, দক্ষ পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহিতা তন্ত্র থাকা প্রয়োজন। CRC-এর রিপোর্টিং মেকানিজমের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাদের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ রিপোর্ট করতে হয়; কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি তখনই কার্যকর হবে যখন স্থানীয় পর্যায়ে তথ্যসংগ্রহ, ডেটা ব্যবস্থাপনা ও স্বাধীন পর্যবেক্ষণ শক্তিশালী করা হবে। শিশুদের নিজস্ব কণ্ঠস্বরকে কেবল নীতিতেই নয়, বাস্তব কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে—বিদ্যালয়-পরিষদ, স্থানীয় বাচ্চাদের ফোরাম ও অংশগ্রহণমূলক মূল্যায়ন এমন পদ্ধতি যা নীতি-নির্মাণ ও মূল্যায়নে বদল এনতে পারে।
বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব শিশু দিবসের আবেদন অনুষঙ্গিক। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের বহু সূচক—স্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষায় নামভর্তি, টিকা-প্রতিস্তর—উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে; তবে শিশুশ্রম, ম্যালনিউট্রিশন, শিশু-বিবাহ ও ট্রাফিকিং-নিয়ন্ত্রণসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা এখনও সমাধান চায়। নগরায়েরণ ও দূরবর্তী গ্রামীণ অঞ্চলের মধ্যে সেবার অপ্রতিষ্ঠিততা, শিক্ষার মানগত বৈষম্য, এবং জলবায়ু-প্রবণতায় শিশুদের ঝুঁকি বাড়ছে—এইসব প্রসঙ্গ স্থানীয় নীতিবিধি ও সামাজিক কার্যক্রমে সময়োপযোগী রূপান্তরের দাবি রাখে।
বিশ্ব শিশু দিবস কেবল একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান নয়; এটি একটি আন্তর্জাতিক নৈতিক ও নীতিগত মনোদৈর্ঘ্য—যা শিশু অধিকারকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য রাষ্ট্র ও সমাজকে স্মরণ করিয়ে দেয় তাদের প্রতিশ্রুতি এবং দায়িত্ব। শিশুদের সম্মিলিত কল্যাণ নিশ্চিত করা হলে সেদিনই সমাজের ভবিষ্যৎ স্বচ্ছ ও টেকসই হবে; সেই লক্ষ্যে গবেষণা-ভিত্তিক নীতি, গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ, অর্থনীতি-সমর্থিত বাস্তবায়ন এবং কার্যকর নজরদারি—এই চারটি ভিত্তিক উপাদানকে কেন্দ্র করে বিশ্ব শিশু দিবসকে কেবল উৎসব নয়, বরং কর্মপরিকল্পনার তীব্র আহ্বান হিসেবে ধরা উচিত।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব শিশু দিবসের গুরুত্ব এমন এক বহুমাত্রিক বাস্তবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন, সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য ও মানবাধিকার—সবগুলো ক্ষেত্রই একইসঙ্গে শিশুদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ফলে ২০ নভেম্বরের এই দিনটি কেবল সচেতনতার আনুষ্ঠানিক অনুশীলন নয়; বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যত জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রগঠনের জন্য এক ধরনের নীতিগত প্রতিশ্রুতির পুনর্গঠন। শিশুদের কেন্দ্র করে যেসব বৈষম্য, সম্ভাবনা ও ঝুঁকি একই সঙ্গে কার্যকর থাকে, বিশ্ব শিশু দিবস তার মধ্যেই একটি সমন্বিত আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করে, যার বৈজ্ঞানিক ও নীতিগত গুরুত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যাগত কাঠামো শিশুদের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট করে তোলে। জনমিতি অনুসারে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই শিশু ও কিশোর; তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা ও বিকাশের যথাযথ নিশ্চয়তা ছাড়া রাষ্ট্রের মানবসম্পদ প্রস্তুতই অসম্ভব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিবর্তন, গ্রামগঞ্জ থেকে শহরে ব্যাপক অভিবাসন, শিল্পায়ন, প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, এবং সমাজের স্তরবিন্যাসের পরিবর্তন—এসবই শিশুদের জীবনে নতুন সুযোগের পাশাপাশি নতুন সংকটও সৃষ্টি করেছে। শহরাঞ্চলে ভিন্ন মাত্রার চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান—বস্তিবাসী শিশুদের নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, স্কুলে উপস্থিতি, পুষ্টি, এবং নির্যাতন থেকে সুরক্ষা এখনও কাঙ্ক্ষিত নয়; অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। বিশ্ব শিশু দিবস ঠিক এপ্রেক্ষাপটে স্মরণ করিয়ে দেয় যে জাতীয় উন্নয়ন কেবল অবকাঠামোগত অগ্রগতি নয়—বরং মানবমনে, বিশেষ করে শিশুর মনে বিনিয়োগের মধ্য দিয়েই টেকসই হতে পারে।
বাংলাদেশের নীতিগত বাস্তবতায় শিশু অধিকার কনভেনশন (CRC)-এর স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে যে দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে তা বিশ্ব শিশু দিবসের আলোচনাকে আরও গভীর করে তোলে। যদিও দেশে শিশু সুরক্ষা আইন, জাতীয় শিশু নীতি, এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। আইনি কাঠামো যথেষ্ট হলেও বিচারপ্রক্রিয়ার গতি, শিশু আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি, শিশুবান্ধব পুলিশিং, বিশেষ বরাদ্দ ও মনিটরিং—এসব ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত পরিপক্বতা অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে বিদ্যমান প্রথাগত ধারণা—যেখানে শিশুকে এখনো প্রাপ্তবয়স্কদের ‘অনুগত’ সদস্য হিসেবে দেখা হয়—এটিও তাদের সিদ্ধান্তগ্রহণ বা অংশগ্রহণ সীমিত করে। বিশ্ব শিশু দিবস তাই শিশুদের স্বতন্ত্র অধিকারধারী সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সাংস্কৃতিক ও নৈতিক প্রয়োজনটিকে নতুনভাবে তুলে ধরে।
শিশুশ্রম বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে—যেমন ক্ষুদ্র কারখানা, কৃষিকাজ, দোকান, রিকশা-মেরামত কেন্দ্র বা গার্মেন্টসের উপশাখা—শিশুশ্রম এখনও একটি উদ্বেগজনক চিত্র। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, পরিবারিক চাপ এবং শিক্ষার ব্যয় শিশুদের শ্রমবাজারে ঠেলে দেয়, যেখানে তারা শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক ঝুঁকির মুখে পড়ে। বিশ্ব শিশু দিবস এই চর্চাকে শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে নয়, বরং জাতীয় উন্নয়ন ও তরুণ মানবসম্পদ গঠনের পথে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। একইসঙ্গে এটি সরকার, উন্নয়ন সংস্থা ও নাগরিক সমাজকে শৈশবের মৌলিক সুরক্ষা এবং শিশুর শিক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের শিশুদের ওপর আরেকটি বিশেষ প্রভাব ফেলে। ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা—এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বড় সংখ্যক পরিবারের বাসস্থান ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুদের শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়, অপুষ্টি বৃদ্ধি পায়, মানসিক চাপ ও ট্রমা তৈরি হয়, এবং শিশুবিবাহসহ বহু সামাজিক ঝুঁকি বাড়ে। জলবায়ু-প্রবণ অঞ্চলের শিশুরা বাস্তবে দ্বিগুণ বৈষম্যের মুখোমুখি—একদিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে পরিবেশগত ঝুঁকি। বিশ্ব শিশু দিবস এই কাঠামোটি বোঝায় যে পরিবেশগত ন্যায় ও শিশু অধিকার পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; বরং একটির সুরক্ষা অন্যটির জন্য অপরিহার্য।
শিশুদের ডিজিটাল নিরাপত্তা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তুলনামূলক নতুন কিন্তু অত্যন্ত গুরুতর একটি চ্যালেঞ্জ। ইন্টারনেট ব্যবহারের দ্রুত সম্প্রসারণ শিশুদের শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সুযোগ তৈরি করেছে, তবে একইসঙ্গে সাইবার বুলিং, অনলাইন গ্রুমিং, ভুয়া তথ্য, পর্নোগ্রাফি ও ডেটা নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশ্ব শিশু দিবস এই জটিল বাস্তবতায় ডিজিটাল সিটিজেনশিপ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও শিশুবান্ধব প্রযুক্তিনীতির গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ ছাড়া বাংলাদেশে শিশুদের রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্র থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন রাখার একটি সাংস্কৃতিক বাস্তবতা রয়েছে। শিশুদের মতামত, অংশগ্রহণ এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণে তাদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দেয়া—এই চিন্তাটি এখনও প্রতিষ্ঠানগতভাবে গৃহীত হয়নি। বিশ্ব শিশু দিবস এ জায়গায় এক ধরনের নৈতিক চাপ তৈরি করে—নীতিনির্ধারণে শিশুদের অন্তর্ভুক্তি কেবল মানবাধিকার নয়, বরং স্মার্ট, অংশগ্রহণমূলক ও টেকসই প্রশাসনের অন্যতম শর্ত।
সার্বিকভাবে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব শিশু দিবস জাতীয় উন্নয়ন, নীতি-সংস্কার, সামাজিক ন্যায়, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এবং জলবায়ু-সংবেদনশীল ভবিষ্যৎ নির্মাণের একটি কেন্দ্রীয় দিক। শিশুদের সুরক্ষা এবং তাদের সম্ভাবনা বিকাশকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে না আনলে দেশের দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতি কেবলই ভঙ্গুর থেকে যাবে। তাই বিশ্ব শিশু দিবস গণসচেতনতার একটি দিন থেকে অনেক বেশি—এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রতিশ্রুতিশীল একটি পথনকশা নির্দেশ করে।
উপসংহারে বলা যায়, শিশুদের অধিকার, নিরাপত্তা ও সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করার করণীয়গুলো কেবল প্রশাসনিক নির্দেশনা বা সামাজিক সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে না—এগুলো একটি রাষ্ট্রের ধারণাগত পরিপক্বতা, নৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং মানবসম্পদ-নির্ভর উন্নয়নদর্শনের গভীর প্রতিফলন। বিশ্ব শিশু দিবস এই উপলব্ধি পুনর্বিন্যস্ত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যেখানে করণীয়গুলোকে শুধুমাত্র কর্মতালিকা হিসেবে নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য কাঠামো হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
শিশুদের নিরাপদ, সুরক্ষিত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির পূর্ণ বাস্তবায়ন—যেখানে শিশুকে পিতামাতা বা রাষ্ট্রের দায়সারা অভিভাবকত্বের ছায়ায় নয়, বরং স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকর করতে রাষ্ট্রকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সামাজিক সুরক্ষা ও শিশু সুরক্ষা খাতে নির্দিষ্ট এবং স্বচ্ছ বাজেটায়ন নিশ্চিত করতে হবে। শুধুমাত্র বরাদ্দ বাড়ানো নয়, বরং প্রমাণ-ভিত্তিক পরিকল্পনা, দক্ষ প্রতিষ্ঠান এবং কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুদের প্রাপ্ত সুবিধার গুণমানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এছাড়া পরিবার, বিদ্যালয় ও ডিজিটাল পরিবেশে শিশুর অংশগ্রহণমূলক অধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শিশুর মতামত ও অভিজ্ঞতাকে নীতি ও কর্মপরিকল্পনায় যুক্ত করা হলে সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো আরও বাস্তবসম্মত ও টেকসই হয়। ডিজিটাল যুগে শিশুদের সাইবার-সুরক্ষা, তথ্য-দক্ষতা এবং নৈতিক ব্যবহার শেখানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর শোষণ থেকে রক্ষায় আইনগত কাঠামোকে যুগোপযোগী করা অপরিহার্য।
একইসঙ্গে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি ও সামাজিক বৈষম্যের যে বিস্তৃত বাস্তব চিত্র বাংলাদেশের শিশুদের মুখোমুখি করছে, তার প্রতিরোধে বহুমাত্রিক নীতি সমন্বয় প্রয়োজন—পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাব নিরসনে শিশু-কেন্দ্রিক অভিযোজন কৌশল, জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে শিক্ষা ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী মনোসামাজিক সহায়তা—এসব উপাদান শিশু সুরক্ষা কাঠামোর সঙ্গে আরও দৃঢ়ভাবে যুক্ত করতে হবে।
তদুপরি, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ ও মানবপাচারের মতো গভীর সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য বিকল্প আয়ের সুযোগ, শিক্ষার ব্যয় হ্রাস, এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক সচেতনতা—সবগুলোই সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। কারণ এসব সমস্যার মূল উৎস অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনিশ্চয়তা; তাই এগুলোর প্রতিরোধ কেবল দমনমূলক প্রক্রিয়ায় সম্ভব নয়, বরং প্রতিরোধমূলক সামাজিক ন্যায্যতার কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
ফলে করণীয়ের মূল দিকগুলোকে একটি সমন্বিত নীতি-তন্ত্রে রূপান্তর করা জরুরি—যেখানে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং শিশুর নিজের অংশগ্রহণ একটি সমন্বিত চক্র তৈরি করে। এই চক্রটি যত শক্তিশালী হবে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ততই নিরাপদ, ন্যায্য ও টেকসই হবে। বিশ্ব শিশু দিবস তাই প্রতিবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়: শিশুদের অধিকার ও সম্ভাবনার সুরক্ষা কোনো অতিরিক্ত মানবতাবোধ নয়; এটি জাতীয় উন্নয়নের গভীরতম ভিত্তি, এবং সেই ভিত্তির দৃঢ়তা নিশ্চিত করাই আমাদের মূল করণীয়।
(ওএস/এসপি/নভেম্বর ১৮, ২০২৫)
