প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
দক্ষিণ এশিয়ায় দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক সুরক্ষার ভূমিকা
২০২৫ ডিসেম্বর ২১ ১৮:০২:৫০
ওয়াজেদুর রহমান কনক
দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর বহুমুখিতা। বাংলাদেশের 'সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী' কর্মসূচি যেমন অতি-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টি ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়, ভারতের 'মনরেগা' (MGNREGA) তেমনি গ্রামীণ শ্রমশক্তির আইনি কাজের অধিকার নিশ্চিত করে। তবে উচ্চতর গবেষণার দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই নেটওয়ার্কগুলো প্রায়শই 'অন্তর্ভুক্তি ও বর্জন ত্রুটি' (Inclusion and Exclusion Errors) দ্বারা সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ, যাদের প্রকৃত সহায়তা প্রয়োজন তারা অনেক সময় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে বাদ পড়ে যাচ্ছে, আবার সচ্ছল গোষ্ঠী অন্যায্যভাবে সুবিধা গ্রহণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতা হলো এখানে দারিদ্র্য কেবল আয়ের অভাব নয়, বরং এটি লিঙ্গ, জাতিসত্তা এবং ভৌগোলিক অবস্থানের সাথে গভীরভাবে জড়িত।
Universal Basic Income (UBI) বা সর্বজনীন মৌলিক আয়ের ধারণাটি এই অঞ্চলে একটি বৈপ্লবিক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। প্রথাগত সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ (Targeting) করতে গিয়ে যে বিশাল প্রশাসনিক ব্যয় এবং ত্রুটি দেখা দেয়, UBI তা নিরসনের একটি তাত্ত্বিক সমাধান হতে পারে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার মতো জনবহুল ও সীমিত সম্পদের দেশে এটি কতটুকু টেকসই হবে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। গবেষণায় দেখা যায় যে, সরাসরি নগদ অর্থ প্রদান (Direct Benefit Transfer) প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা বাড়ালেও, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে কাঠামোগত বিনিয়োগ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদী মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্ককে কেবল 'জীবন রক্ষার ঢাল' হিসেবে না দেখে 'দারিদ্র্যের ফাঁদ' (Poverty Trap) থেকে বের হওয়ার সিঁড়ি হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে SDG 1 এবং সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্কের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত দুই দশকে দারিদ্র্য বিমোচনে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করলেও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলো এখনো প্রকট। বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো মূলত জীবনচক্রভিত্তিক (Life-cycle approach) মডেলে রূপান্তরিত হচ্ছে, যা জন্ম থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত নাগরিকের ঝুঁকি হ্রাসের চেষ্টা করে। সরকারের 'জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল' (NSSS) এই লক্ষ্যেই প্রণীত হয়েছে, যাতে প্রচলিত খণ্ডিত কর্মসূচিগুলোকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত কাঠামোর আওতায় আনা যায়। তবে এই রূপান্তরের পথে প্রশাসনিক সক্ষমতা এবং স্বচ্ছতা এখনো বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড় বাধা হলো 'নগর দারিদ্র্য' (Urban Poverty) এবং 'জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি'। গ্রামীণ এলাকায় ভিজিডি, ভিজিএফ বা কাবিখার মতো কর্মসূচিগুলো শক্তিশালী হলেও, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে শহরে আসা বস্তিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকর সামাজিক সুরক্ষার অভাব পরিলক্ষিত হয়। উচ্চতর গবেষণার নিরিখে এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমলেও বৈষম্য বা 'গিনি সহগ' (Gini Coefficient) ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অর্থ হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্তের কাছে অধিকতর পুঞ্জীভূত হচ্ছে, আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কেবল ন্যূনতম বেঁচে থাকার রসদ পাচ্ছে।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে 'গ্র্যাজুয়েশন মডেল' (যেখানে অনুদান থেকে শুরু করে স্বনির্ভরতা পর্যন্ত ধাপে ধাপে সহায়তা দেওয়া হয়) অত্যন্ত কার্যকর। SDG-1 অর্জনে বাংলাদেশকে এখন কেবল বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর দিকে নয়, বরং উপকারভোগী নির্বাচন পদ্ধতিতে শতভাগ স্বচ্ছতা এবং ডিজিটাল ডাটাবেজ বা 'সোশ্যাল রেজিস্ট্রি'র নিখুঁত ব্যবহারের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্ক দক্ষিণ এশিয়ায় দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান নীতিগত হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত। সামাজিক সুরক্ষা বলতে সাধারণত নগদ ভাতা, খাদ্য সহায়তা, কর্মসংস্থানভিত্তিক কর্মসূচি, সামাজিক বিমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে এসব কর্মসূচি বিদ্যমান থাকলেও তাদের কাঠামো, লক্ষ্য নির্ধারণ ও কার্যকারিতায় বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামাজিক সুরক্ষা প্রতিক্রিয়াশীল, খণ্ডিত ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত, যা দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য বিমোচনের পরিবর্তে সাময়িক উপশমে সীমাবদ্ধ থাকে।
এখানেই Universal Basic Income (UBI) ধারণাটি দক্ষিণ এশিয়ার নীতিগত আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। UBI-এর মূল যুক্তি হলো, প্রত্যেক নাগরিককে শর্তহীন ন্যূনতম আয় প্রদান করা, যাতে মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত হয় এবং মানুষ ঝুঁকির মুখে সম্পূর্ণভাবে নিঃস্ব না হয়। দক্ষিণ এশিয়ার মতো উচ্চ দারিদ্র্য ও অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিনির্ভর অঞ্চলে UBI তাত্ত্বিকভাবে সামাজিক সুরক্ষার জটিলতা কমাতে পারে। তবে বাস্তবতার প্রশ্নে এর অর্থায়ন, মুদ্রাস্ফীতি, লক্ষ্য নির্ধারণের নৈতিকতা এবং বিদ্যমান কল্যাণ কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় নিয়ে গভীর বিতর্ক রয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, আংশিক বা লক্ষ্যভিত্তিক UBI মডেল দক্ষিণ এশিয়ায় বেশি বাস্তবসম্মত হতে পারে, বিশেষ করে যখন এটি স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগের সঙ্গে যুক্ত হয়।
স্বাস্থ্যব্যবস্থা SDG 1 ও সামাজিক সুরক্ষার আরেকটি কেন্দ্রীয় উপাদান। দক্ষিণ এশিয়ায় দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ হলো স্বাস্থ্যজনিত ব্যয়। ব্যক্তিগত খরচনির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থা দরিদ্র পরিবারকে সহজেই দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দেয়। তাই সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য বিমা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ SDG 1 অর্জনের জন্য অপরিহার্য। সামাজিক সুরক্ষা যদি স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে না পারে, তবে দারিদ্র্য বিমোচন টেকসই হয় না।
শিক্ষা ও লিঙ্গ সমতাও এই বিশ্লেষণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় মেয়েদের শিক্ষা ও নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানো দারিদ্র্য হ্রাসে সবচেয়ে কার্যকর কৌশলগুলোর একটি হিসেবে প্রমাণিত। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে যদি লিঙ্গসংবেদনশীল নকশা না থাকে, তবে তা বিদ্যমান বৈষম্য আরও গভীর করতে পারে। একইভাবে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের অভাব স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দারিদ্র্যের চক্রকে দীর্ঘায়িত করে, যা SDG 6-এর সঙ্গে SDG 1-এর গভীর সংযোগকে স্পষ্ট করে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
