প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত
কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না মাটিখেকোদের
২০২৫ ডিসেম্বর ২৪ ১৯:২৫:২১
যশোর প্রতিনিধি : যশোর সদর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের বাউলিয়া গ্রামে ফসলি জমির 'টপ সয়েল' বা উর্বর উপরের মাটি অবৈধভাবে কেটে বিক্রির ঘটনা কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। একটি প্রভাবশালী চক্র দীর্ঘদিন ধরে নির্বিচারে এই কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এলাকার কৃষকদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। কৃষকরা এই অবৈধ মাটিখেকো সিন্ডিকেট বন্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।
আজ বুধবার দুপুরে ফতেপুর ইউনিয়নের বাউলিয়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি লিখিত আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
আবেদনে কৃষকরা উল্লেখ করেছেন, তারা ফতেপুর ইউনিয়নের বাউলিয়া গ্রামের মৌজায় কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করনে। সম্প্রতি তাদের ফসলি জমির পাশের জমির মালিক মাহাফুজ কোনো প্রকার অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে গভীর গর্ত করে মাটি বিক্রয় করছেন। ফলে তার জমির লাগোয়া পার্শ্ববর্তী জমিগুলো ভেঙে নিচে চলে যাচ্ছে। সেচের পানিতে বিঘ্নসহ নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হবে। যা কৃষিকাজের অনুকূল পরিবেশে বাধা সৃষ্টি করবে। কৃষকরা তাদের কৃষি কাজ নির্বিঘ্নে করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে এই মাটি কেটে গর্ত সৃষ্টি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
সরেজমিন ফতেপুর ইউনিয়নের বাউলিয়া মাঠে গিয়ে দেখা যায়, এসকোভেটর মেশিন দিয়ে ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। মাটি কাটার ফলে পাশের জমির মালিকদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মাটি কাটা জমিগুলো তাদের জমির তুলনায় অনেক নিচু হয়ে যাচ্ছে। যা জমির স্বাভাবিক আইল ও কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
স্থানীয় চাষি মিজানুর রহমান, জুলফিকার আলী ও তামিম হোসেন অভিযোগ করে বলেন, একটি চক্র রাতের আঁধারে ফসলি জমির মাটি কাটছে। এতে আমাদের জমিগুলো তাদের কাটা জমির পাশে থাকাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা প্রশাসনের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।
এই অবৈধ ব্যবসার সাথে ফতেপুর ইউনিয়নের আশরাফুল ইসলাম, মো. মুন্না, সাগর হোসেন ও মো. রানা নামের কয়েকজন ব্যক্তি জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে এই অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঘটনাস্থলে মাটি কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্তদের একজন আশরাফুল ইসলাম মাটি কাটার বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন। অন্যদিকে, জমির মালিক মাহফুজ হোসেন দাবি করেন, তার জমি উঁচু থাকাতে তিনি মাটি বিক্রি করছেন। তবে সরেজমিনে দেখা যায়, তার জমি আশেপাশের জমির তুলনায় নিচুই।
ফতেপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম এই অবৈধ কাজের নিন্দা জানিয়ে বলেন, যারা মাটি কাটছে, তারা কোনো রাজনৈতিক দলের পরিচয় ব্যবহার করলে প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। আমরা চাই ফসলি জমির মাটি কাটা বন্ধ হোক।
ফসলি জমির টপ সয়েল বা উর্বর মাটি কেটে বিক্রি করা একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। এই বিষয়ে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের আইনে কৃষি জমির মাটি কেটে বিক্রি করার বিরুদ্ধে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ (সংশোধিত আইন, ২০১৭)। সেখানে ধারা-৪ (১) কৃষি জমি থেকে মাটি উত্তোলন বা অপসারণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ধারা-৫ কৃষি জমি থেকে মাটি কাটার অপরাধে শাস্তির বিধান রয়েছে। এই আইনের অধীনে লাইসেন্স ছাড়া বা কৃষি জমি থেকে মাটি কাটলে ২ (দুই) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ (দশ) লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
ফসলি জমির মাটি কেটে পার্শ্ববর্তী জমির ক্ষতিসাধন (জমির আইন ও সীমানা ক্ষতিগ্রস্ত করা), সেচে বাধা সৃষ্টি করা বা অন্য কোনো জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে ফৌজদারি কার্যবিধি ও দণ্ডবিধির প্রাসঙ্গিক ধারাগুলোতে মামলা দায়ের করা যায়। সেখানে দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ধারা ৪২৭ (ক্ষতিসাধন) এই ধারায় ক্ষতিসাধন বা অনিষ্টের জন্য শাস্তি হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জমির ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানি মামলাও দায়ের করতে পারেন।
এ বিষয়ে সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম হোসাইন বলেন, জমির টপ সয়েল বিক্রি করা বা কাটা একটি ফৌজদারি অপরাধ। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এদিকে, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ করার পর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাটিখেকোরা হুমকি-ধামকি দিচ্ছে বলেও জানা গেছে। তবে প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করতে এবং মাটিখেকো সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
(এসএ/এসপি/ডিসেম্বর ২৪, ২০২৫)
