প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
ক্ষমা করে দিও দিপু
২০২৫ ডিসেম্বর ২৫ ১৬:৫৫:৫১
শিতাংশু গুহ
ক্ষমা করে দিও দিপু, আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারিনি। তোমাকে যখন ওঁরা ভালুকার রাস্তায় মারতে মারতে অচেতন করে ফেলে তখন তোমার কি অনুভূতি হয়েছিলো আমি জানিনা, শুধু এটুকু জানি তুমি বাঁচতে চেয়েছিলো, হয়তো বলতে চেয়েছিলে, আমি কোন অন্যায় করিনি, তোমার ধর্মে আঘাত হানিনি, আমি মুহাম্মদের নিন্দা করিনি। ওরা অসুর, ওরা শুনেনি তোমার কথা। ওরা মানুষ না, ওরা মুসলমান না, ওরা তৌহিদী জনতা। ওঁরা মানুষ মেরে ধর্ম পালন করে?
তোমাকে যখন কারখানা থেকে ধাক্কা মেরে উন্মত্ত জনতার হাতে তুলে দেয়া হয়, যখন তোমার শরীরে প্রথম হায়েনার আঘাত পড়ে, তখন হয়তো তুমি ব্যথায় কাতরে উঠেছিল, এরপর তো মারের পর মার, মার খেতে খেতে তুমি অচেতন হয়ে পড়েছিলে, তাতেও ওরা ক্ষান্ত হয়নি, তোমার উলঙ্গ দেহ রাস্তা দিয়ে টেনে হিচড়ে, লাথি মারতে মারতে নিয়ে যায় মহাসড়কের পাশে ঐ গাছটা’র কাছে?
এরপর কি পৈশাচিক আনন্দে ওরা তোমার গলায় দড়ি দেয়, তোমার অর্ধ-মৃত দেহ ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। শত শত ক্যামেরা জ্বলে উঠে, এ দৃশ্য ধরে রাখা চাই, হিন্দুর ফাঁসী, এক মালাউনের ফাঁসি। ‘আল্লাহুআকবার’ ধ্বনিতে পুরো এলাকা কম্পিত হয়ে ওঠে। এরপর তোমার দেহে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, ভীড়ের মধ্যে একজনও কাঁদেনি, কেউ ব্যথা পায়নি, কারো মনে হয়নি তুমিও মানুষ।
তোমার মৃত্যুতে সবাই খুশি, কেউ বিচার চায়নি। কোন কাগজে তোমার নিউজ আসেনি, বিবিসি বাংলা প্রথম তা প্রকাশ করে। ঐ খবরের নীচে অসংখ্য ‘আলহামদুল্লিলাহ’ দেখে তুমি হয়তো ভাবছো, এরাও ‘মানুষ’? না, ওঁরা মানুষ না, ওঁরা অমানুষ, ওঁরা তৌহিদী জনতা। তুমি ওদের চিনতে পারেনি, চিনবেই বা কিভাবে, আসলে ‘অমানুষগুলো’ও দেখতে তো মানুষেরই মত!
দিপু, দুঃখ হয় তোমার জন্যে, এমন এক দেশে তুমি জন্মেছ, যেখানে ওঁরা মানুষ মেরে ধর্মের জয়গান গায়, যেদেশে রাস্তার কুকুর মরলে কিছু মানুষ এখনো দু:খ পায়, হিন্দু মরলে নয়। সামাজিক মিডিয়া বলছে, তোমার অর্ধ-দগ্ধ দেহ নাকি তোমার বাড়ীতে ঢুকতে দেয়নি, এমনকি তোমার দাহকার্য সম্পন্ন করে ঘরে ফেরার পথে শবযাত্রী তোমার আত্মীয় স্বজনের সাথে কিছুলোক খারাপ ব্যবহার করেছে?
রাষ্ট্র তোমার জন্যে কিচ্ছু করেনি। কেন করবে? তোমাকে তো মেরেছে রাষ্ট্র। শুধু তুমি নও, রাষ্ট্র গত ৫৪বছর ধরে তোমার মত হিন্দুদের মারছে। কারণ এই রাষ্ট্রের একটি ধর্ম আছে, সেই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে তুমি জন্মছিলে কেন? ওদের কাছে তুমি নিকৃষ্ট, তোমার বাঁচার অধিকার নাই? তুমি মরে বেঁচেছো, হায়েনার মুখে রেখে গেছো তোমার যুবতী বধূ ও শিশু কন্যা।
ডিসি সাহেব বলে গেছেন তোমার স্ত্রীর মেঘনা’র জন্যে একটি চাকুরী খুঁজে দেবেন। শিক্ষা উপদেষ্টা সান্তনা দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা টুইট করেছেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সাফাই গেয়েছেন, এটি সংখ্যালঘু নির্যাতন নয়! শেখ হাসিনা বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি বিচার করবেন। হেসো না বন্ধু, তিনি মদিনা সনদ কায়েম করেছেন, ২০০১, ২০১২-২০১৮ হিন্দু নির্যাতনের বিচার করেননি, এবার হয়তো করবেন, আশা ছেড়োনা।
তুমি হয়তো সামান্য গার্মেন্টস শ্রমিক ছিলে, কিন্তু তুমি মরে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছো, তৌহিদী জনতা কতটা বর্বর। বিশ্বের বড়বড় মিডিয়ায় তোমার খবর বেরিয়েছে। মরে গিয়েও তুমি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছো। সারা বিশ্বে তোমার জন্যে আন্দোলন হচ্ছে। তোমার কারখানার বন্ধুরা চাপে পরে এখন তোমার বিরুদ্ধে একটি ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছে?
তোমার মৃত্যু বাংলাদেশের হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করুক, দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলুক, অত্যাচারীর হাত ভেঙ্গে দিতে শিখুক। আমরা অমৃতের সন্তান, তোমার মৃত্যু নেই, আমাদের মাঝে তুমি বেঁচে থাকবে। যেখানেই থাক ভাল থাকো। স্বর্গ থেকে তুমি তোমার মেয়েকে আশীর্ব্বাদ করো গীতিকা যেন দেবী দূর্গা হয়ে উঠতে পারে, যাতে পিতৃহন্তা অসুরদের ওপর নির্মম প্রতিশোধ নিতে পারে।
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।
