ঢাকা, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

বিশ্ব মহামারী প্রস্তুতি দিবস

করোনা সংকটের শিক্ষা ও ভবিষ্যতের ভয়ঙ্কর বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য সতর্কতা

২০২৫ ডিসেম্বর ২৬ ১৮:১৩:১৯
করোনা সংকটের শিক্ষা ও ভবিষ্যতের ভয়ঙ্কর বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য সতর্কতা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


মানব সভ্যতার ইতিহাসে মহামারি কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। প্লেগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সালমোনেলা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের উদাহরণ হাজার বছর ধরে মানুষের সামনে এসেছে। তবে আধুনিক বিজ্ঞান ও উন্নত চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও কোভিড–১৯ প্রমাণ করেছে, একটি সংক্রামক ভাইরাস পুরো পৃথিবীকে থামিয়ে দিতে সক্ষম। এই অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য এক গভীর শিক্ষা। তাই ২০২০ সালে জাতিসংঘ ২৭ ডিসেম্বরকে বিশ্ব মহামারি প্রস্তুতি দিবস ঘোষণা করে। লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট—ভবিষ্যতে যেন কোনো মহামারি বিশ্বকে অপ্রস্তুত অবস্থায় না পায়।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব

কোভিড–১৯ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, কোনো দেশ একা মহামারির সঙ্গে প্রতিরোধ করতে পারে না। সমন্বিত আন্তর্জাতিক প্রস্তুতি, স্বাস্থ্য নীতি, তথ্য বিনিময় এবং গবেষণার মাধ্যমে আমরা পৃথিবীকে আরও সুরক্ষিত করতে পারি। শুধুমাত্র নিজের দেশ নয়, বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিটি জাতি মহামারির ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে পারে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সরকারের মধ্যে সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন। এছাড়া, টিকা, ওষুধ ও চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করতে দেশের মধ্যে প্রস্তুতি ও আন্তর্জাতিক সহায়তা একসাথে থাকা জরুরি।

কোভিড–১৯: এক বৈশ্বিক বিপর্যয়ের সূচনা

২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে এটি বিশ্বের প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালের মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে কোভিড–১৯কে মহামারি ঘোষণা করে। এরপর শুরু হয় এক দীর্ঘ, ভয়াবহ এবং ব্যয়বহুল সময়। কোভিড–১৯-এর প্রভাব শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না—অর্থনীতি, শিক্ষা, সামাজিক স্থিতিশীলতা, মানসিক স্বাস্থ্য এবং দৈনন্দিন জীবনেও এটি গভীর ছাপ ফেলেছে।

কোভিড–১৯ শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যই হুমকি ছিল না। মানুষ দৈনন্দিন জীবনে, পরিবারে এবং কর্মক্ষেত্রে চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব এবং অপ্রত্যাশিত চাকরিহীনতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। একাকীত্ব, উদ্বেগ এবং মানসিক চাপ বহু মানুষের জীবনে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। অনেকের জন্য এটি জীবনের এক অচেনা অধ্যায়—শিশুরা স্কুলে যেতে পারেনি, চাকুরিপ্রার্থীরা দুশ্চিন্তায় ভুগেছে, আর বৃদ্ধরা সামাজিক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

২০২০–২০২৫: বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের চিত্র

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক তথ্যভাণ্ডারের হিসাব অনুযায়ী, মহামারির প্রথম পাঁচ বছরে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ কোটির বেশি। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ অনেক দেশ ২০২৩ সালের পর নিয়মিত রিপোর্টিং কমিয়ে দিয়েছে।

* ২০২০ সাল: মহামারির সূচনা, প্রস্তুতির ঘাটতি, সংক্রমণ ও মৃত্যুর দ্রুত বৃদ্ধি।

* ২০২১ সাল: ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব, সংক্রমণ ও মৃত্যুর সর্বোচ্চ চাপ।

* ২০২২ সাল: ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট; সংক্রমণ ব্যাপক হলেও মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম।

* ২০২৩–২০২৫ সাল: টিকাদান, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে মৃত্যুহার কমে আসে, তবে সংক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সংক্রমণ এখনও চলমান। কারণ, বিশ্বে একক ও সমন্বিত স্বাস্থ্য তথ্যব্যবস্থা নেই। অনেক উন্নয়নশীল দেশে পরীক্ষার সুযোগ সীমিত, এবং বহু মৃত্যুকে করোনা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়নি। ফলে সরকারিভাবে ঘোষিত সংখ্যা বাস্তবতার পুরো চিত্র তুলে ধরে না।

মৃত্যুর ভয়াবহতা ও সামাজিক ক্ষতি

সরকারিভাবে রিপোর্ট করা মোট মৃত্যু সংখ্যা ৭১ লক্ষের বেশি। তবে প্রকৃত সংখ্যা আন্তর্জাতিক গবেষণায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ থেকে ৩ কোটিরও বেশি হতে পারে। মৃত্যুর পাশাপাশি, মহামারি মানবজীবনের বহু ক্ষেত্রে ক্ষতি করেছে—কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়েছে, শিশুদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা ভেঙে গেছে, অসংখ্য পরিবার প্রিয়জন হারিয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবন ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। এটি মানব ইতিহাসে এক অনন্য ত্যাগের উদাহরণ।

মহামারি আমাদের স্মরণ করিয়েছে যে মৃত্যু শুধু সংখ্যা নয়। এটি পরিবার ও সমাজে শূন্যতা তৈরি করে, প্রিয়জনের অভাব মানসিক ক্ষতিও সৃষ্টি করে। কোভিড–১৯-এর প্রভাব বহু পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করেছে। অসুস্থ পরিবারগুলোতে মানসিক চাপ ও আর্থিক সংকট একসাথে বেড়ে গেছে, যা ভবিষ্যত প্রজন্মের উপরও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে। এছাড়া, মহামারি নারীদের ওপর ভিন্ন মাত্রার চাপ তৈরি করেছে—গৃহকর্ম, অনলাইন শিক্ষা, সামাজিক সহায়তা সংকুচিত হওয়া ইত্যাদিতে নারীর দায়িত্ব বেড়ে গেছে।

অর্থনীতি ও সামাজিক প্রভাব

কোভিড–১৯ শুধু স্বাস্থ্য সংকটই নয়, বিশ্ব অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করেছে।

* ব্যবসা ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি।

* পর্যটন, পরিবহন ও বিনোদন খাত বিপর্যস্ত।

* অনলাইন শিক্ষার প্রসার হলেও শিক্ষার গুণগত মানে ফাঁকফোকর।

* দরিদ্র ও অপ্রতিষ্ঠিত জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

* লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব প্রয়োগে মানুষ একাকী হয়ে পড়েছে।

মানসিক স্থিতিশীলতার ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়েছে। ফলে ভবিষ্যতের জন্য মানসিক প্রস্তুতি অপরিহার্য। মহামারি শিশুদের মানসিক বিকাশ ও শিক্ষাগত দক্ষতার ওপরও প্রভাব ফেলেছে, যা ভবিষ্যতে শিক্ষার মান এবং সামাজিক সামঞ্জস্যের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে যাবে। এছাড়া, মহামারির সময় নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতা, শিশু শ্রম এবং সামাজিক বৈষম্যও বৃদ্ধি পেয়েছে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি

কোভিড–১৯ প্রমাণ করেছে, প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দেশে পর্যাপ্ত হাসপাতাল, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ও মেডিকেল সরঞ্জাম না থাকায় ভীষণ ক্ষতি হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর চাপ ও ঝুঁকি বেড়ে গেছে।

ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও দৃঢ়, সুষ্ঠু ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। টিকাদান, দ্রুত পরীক্ষা, সঠিক চিকিৎসা এবং গবেষণার ওপর বিনিয়োগ একান্ত প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা উচিত। স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে ত্রাণ ও জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।

শিক্ষাগত ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা

মহামারি আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা অপরিহার্য। প্রতিটি দেশের গবেষণাগার, হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে উন্নত করা জরুরি। টিকা ও ওষুধের গবেষণায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। বৈশ্বিক পর্যায়ে তথ্য বিনিময়, অভিজ্ঞতা শেয়ার এবং গবেষণার সমন্বয় ভবিষ্যতে মহামারি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বৈজ্ঞানিক শিক্ষার সঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষার সমন্বয়ও জরুরি। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে—শুধু চিকিৎসক নয়, প্রত্যেক নাগরিককে নিজ দায়িত্বে স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং মহামারি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। শিশু, বৃদ্ধ ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য-সচেতনতা কর্মসূচি চালানো অত্যন্ত জরুরি।

বিশ্ব মহামারি প্রস্তুতি দিবসের শিক্ষা

২০২০–২০২৫ সালের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখেছি—

* মহামারি মোকাবিলায় অবহেলা মানেই প্রাণহানি।

* স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বিলাসিতা নয়; এটি জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

* আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া কোনো দেশই নিরাপদ নয়।

* সঠিক তথ্য ও গবেষণা অপরিহার্য, দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।

* মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ।

* জরুরি ত্রাণ, খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ব মহামারি প্রস্তুতি দিবস কেবল স্মরণ নয়; এটি একটি বৈশ্বিক অঙ্গীকারের আহ্বান। শিক্ষা নিতে পারি—যত দ্রুত সম্ভব প্রস্তুত হওয়া, স্বাস্থ্যসেবা ও গবেষণায় বিনিয়োগ করা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা।

পরিশেষে বলতে চাই,কোভিড–১৯ মানবসভ্যতাকে এক কঠিন আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছে। ২০২০–২০২৫ সালের মধ্যে কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। শিক্ষা স্পষ্ট—ভবিষ্যতে এমন বিপর্যয় এড়াতে হলে এখনই প্রস্তুত হতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ, সচেতনতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা—এই চারটি অনুষঙ্গ ছাড়া মানবজাতি আর কোনো মহামারির ভয়াবহতা এড়াতে পারবে না।বিশ্ব মহামারি প্রস্তুতি দিবস তাই শুধু স্মরণ নয়; এটি মানবজাতির প্রতি সচেতনতা, প্রস্তুতি ও দায়িত্ববোধের আহ্বান। মানবতার শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করতে পারি, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মহামারির ভয়াবহতায় বিপর্যস্ত হবে না।

লেখক: কলাম লেখক ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।