ঢাকা, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » জাতীয় » বিস্তারিত

 

নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকারের বিষয়টি অঙ্গীকার হিসেবে ঘোষণার দাবি

২০২৫ ডিসেম্বর ২৭ ১৯:৫৪:৫৩
নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকারের বিষয়টি অঙ্গীকার হিসেবে ঘোষণার দাবি

স্টাফ রিপোর্টার : নির্বাচনের পূর্বাপর পরিস্থিতি নিয়ে জনগণ শঙ্কিত উল্লেখ করে নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকারের বিষয়টি অঙ্গীকার হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। আজ শনিবার সিরডাপ মিলনায়তনে ‘সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল সংলাপে এ দাবি জানান তারা।

বক্তারা জানান, সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা ও বিচারহীনতা চলমান; রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্বে সুযোগ ও অধিকার ক্রমশ হ্রাস পাওয়া; সাংবিধানিকভাবে সমঅধিকার, সমমর্যাদা ও ধর্মনিরপেক্ষতা আজ চ্যালেঞ্জের মুখে; মত প্রকাশের সুযোগ ক্রমশ সঙ্কুচিত; সাম্প্রদায়িক ও মব সৃষ্টিকারী ব্যক্তির কাছে নতজানু সরকার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আস্তে আস্তে সংখ্যালঘু বিরোধী করা এবং বহুত্ববাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরিয়ে দেয়া যা বাংলাদেশের মূল নীতির পরিপন্থী। এই বাস্তবতায় সকল আলোচক সংখ্যালঘু মানুষের মানবাধিকার আন্দোলন দেশের সকল নাগরিকের আন্দোলনে পরিণত করার আহ্বান জানান।

গোলটেবিল সংলাপে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, জনসংখ্যার আনুপাতি হারে সরকারে, সংসদে, জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংস্থায়, পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীতে অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ, সংখ্যালঘুদের সরাসরি ভোটে সংসদে ৬০টি আসন সংরক্ষণ, দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণ ও বৈষম্যবিলোপ আইন প্রণয়ন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, তিন জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার সম্বলিত নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার জন্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়।

সংলাপে দেশে বিদ্যমান ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতি গভীর শঙ্কা ও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, কোন কোন গোষ্ঠী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ধর্মকে যদৃচ্ছ ব্যবহার করছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে স্থানীয় বা যেকোন ধরণের নির্বাচনে পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নানাভাবে টার্গেট করে রাজনৈতিক ও নানান ধরণের ট্যাগ লাগিয়ে হুমকি, হামলা ও নির্যাতনের শিকার করা হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলসমুহ তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত না করলে তারা ভোটদানে নিরুৎসাহিত হবার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

মি. নির্মল রোজারিও’র সভাপতিত্বে আজ ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ সকালে সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল সংলাপ সঞ্চালনা করেন রঞ্জন কর্মকার। ধারণাপত্র উপস্থাপন করে ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ।

অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন টি আই বি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাংবাদিক আব্দুল আজিজ, তপন মজুমদার, জয়ন্ত কুমার দেব, এ্যাডভোকেট সুমন, ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়, হেমন্ত আই কোড়াইয়া এবং উপস্থিত সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সার্বিক নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে জনগণ শঙ্কিত। এরা কারোর উপরে কোন আস্থা বা ভরসা রাখতে পারছে না। এজন্যে নাগরিকদের মধ্যে ভোটার হবার আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ধর্মীয় পরিচিতির কারণে নাগরিকদের একাংশকে সহিংসতার শিকার করা হচ্ছে। সহিংসতাকারীরা একাত্মবোধকে ধারণ করতে পারছে না। বিভাজনের রাজনীতি ভবিষ্যতে উন্নয়ন, শান্তি, অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে দূর্বল করবে বলে ড. ভট্টাচার্য আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ড. ভট্টাচার্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণ গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন, এজন্যে প্রয়োজন নিরপেক্ষ প্রশাসন। তারেক জিয়া দেশের ‘নিরাপত্তা’র বিষয়টি সামনে নিয়ে আসায় গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, জনাব তারেক জিয়া যে প্ল্যানের কথা বলেছেন তাতে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার নিশ্চিতকরণের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে কি না তা আজ দেখার বিষয়।

আলোচনায় ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কর্তৃত্ববাদের পতন না হলে সকল নাগরিকের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা সবসময় উপেক্ষিত হতে থাকবে। তিনি বলেন, কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের যে অঙ্গীকার তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তাই আমরা কেউ নিরাপদ নয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে আক্রমণ ও সহিংসতা রোধে সুনির্দিষ্ট আইন ও কমিশন থাকা প্রয়োজন। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দেশের মূলধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে তাদের নিজস্ব দাবি-দাওয়াকে তুলে ধরতে হবে। তারজন্যে প্রয়োজন সকল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো।

আলোচনায় ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে যারা ব্যবহার করছে তারা মূলত ফ্যাসিবাদকে সরিয়ে মৌলবাদকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সংখ্যালঘু নারীদেরকে এসব আন্দোলনে আরো বেশী সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন এবং তাদের দাবিগুলো এর সাথে যুক্ত হওয়া দরকার।

আলোচক জনাব শামসুল হুদা বলেন, আমরা ৬০-র দশক থেকে আন্দোলনে রয়েছি, ৭১-র নির্মমতা আমাদের পুনরায় প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। তরুণদের গ্রাফিতিতে বৈষম্যের চিত্র প্রতিফলিত হলেও তা আজ মেঘে ঢাকা পরেছে। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সকল প্রকার নির্যাতন, সহিংসতা ও অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন নতুবা এই সরকার মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হবে। তিনি যুবকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আজকের মানবাধিকার রক্ষায় তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।

ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, আমাদের নীরবতার কারণে আজ সব ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং প্রতিটি দেশে দেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে। আজকে আহমেদিয়া জনগোষ্ঠীকে অমুসলিম ঘোষণার দাবি উঠেছে, যা দুর্ভাগ্যজনক এবং আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। তিনি আরো বলেন, ৫ আগস্টের পরে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি কোন ধরণের আইনের সুরক্ষা পাচ্ছে না। ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ এই বয়ান সামনে রেখে দীপু দাসের উপর যে নগ্ন হামলা, নির্যাতন এবং মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য শরীরে অগ্নিসংযোগ করা এটা শুধু অমানবিক নয় যা মানবাধিকারের সুষ্পষ্ট লংঘন।

এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী সকল কালা কানুন অনতিবিলম্বে বাদ দেয়ার জন্যে আহ্বান জানান।
সাংবাদিক আব্দুল আজিজ বলেন, সামনে নির্বাচন, এই নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে যাতে সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা পায়।

গোলটেবিল সংলাপের সম্মানিত সভাপত মি. নির্মল রোজারিও সকলকে ধন্যবাদ জানান এবং আলোচকবৃন্দের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সংলাপ শেষ করেন।

(পিআর/এসপি/ডিসেম্বর ২৭, ২০২৫)