ঢাকা, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত

৫ বিঘা জমিতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে চাষাবাদ

কালিগঞ্জের চম্পাফুলে ১৭ দিন ধরে অবরুদ্ধ সুনীল মন্ডলের পরিবার

২০২৫ ডিসেম্বর ২৭ ২০:০৪:৩৯
কালিগঞ্জের চম্পাফুলে ১৭ দিন ধরে অবরুদ্ধ সুনীল মন্ডলের পরিবার

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : জমি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার চম্পাফুল কালীবাড়ি বাজারের সুনীল মন্ডলের পরিবারকে প্রাচীর বানিয়ে ও কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ১৭ দিন ধরে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। প্রতিপক্ষ সামাদ গাজী ও তার ছেলে আলমগীর কবীর প্রকাশ্যে সুনীল মন্ডলের পরিবারের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে শৌচাগারের পিছনে, রান্নাঘরের সামনে, উঠানের সামনে ও বসতঘরের পিছনের আমগাছ, নারিকেল গাছ ও লাইট পোষ্টে চারটি সিসি ক্যামেরা বসিয়েছেন। বিরোধপূর্ণ জমি ছাড়াও অন্য জমিতে লাঙ্গল চাষসহ সব ধরণের কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি বসতঘর ভেঙে চলে না গেলে রাতের আঁধারে উচ্ছেদ করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

সরেজমিনে আজ শনিবার দুপুরে চম্পাফুল কালীবাড়ি বাজার সয়লগ্ন দুর্গা মন্দিরের পাশে প্রয়াত সুনীল মন্ডলের বাড়িতে যেয়ে দেখা গেছে বসতঘর, রান্না ঘর ও জ্বালিয়ে দেওয়ার পর নবনির্মিত কাঠঘরের চারিপাশে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে চার বিঘা জমি দখলে নিয়েছেন বেলায়েত গাজীর ছেলে আওয়ামী লীগ কর্মী সামাদ গাজী ও তার ছেলে আলমগীর কবীর। তুলসী বেদী ও টিউবওয়েল বাইরে রেখে বসতঘরের প্রধান ফটকের সামনে দিয়ে পাঁচ ইঞ্চি পুরু ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। শৌচাগারের পিছনের নারিকেল গাছে, উঠানের সামনে আম গাছে, বসতঘরের পিছনে লাইটপোষ্টে মিলিয়ে চারটি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। নারীরা রান্না ঘরে ও শৌচাগারে(পলিথিন মোড়া) গেলে তা সিসি ক্যামেরায় দেখা যায়। জবরদখলকৃত জমিতে সামাদ গাজীর ভাড়াটিয়া শ্রমিকরা কাজ করছে।

মাধবী মন্ডল বলেন, বংশপরম্পরায় তার শ্বশুর সন্ন্যাসী মন্ডলসহ তাদের ভাইয়েরা পৈতৃক জমিতে মাটির ঘরে বসবাস করতেন। সেখানে তাদের প্রায় ৫ বিঘা জমি রয়েছে। ২০০৮ সালে তারা ওয়ারেশসূত্রে পাওয়া জমিতে বসবাস করা শুরু করেন। সেখানে তাদের ৪১ শতক কেনা জমি এবং ওয়ারেশসূত্রে প্রাপ্ত তিন বিঘা জমি অর্পিত সম্পত্তি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে পেয়ে শানিতপূর্ণ ভোগদখলে ছিলেন।

২০১২ সালে সামাদ গাজী ও আলমগীর কবীর হামলা করে পরিবারের সদস্যদের মারপিট করে তাদের (সুনীল) সাড়ে ১৬ শতক জমি জবরদখল করে নেয়। হাজারী লাল মন্ডল মারা যাওয়ার পর প্রথম কমল মন্ডলের কাছ থেকে ১৯৮০ সালে জালজালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি দুটি দলিল মূলে দুই বিঘা জমি দাবি করে আসছিলেন সামাদ গাজী। কাগজপত্রের বৈধতা না থাকায় ২০১৯ সালে নিঃসন্তান হাজারী লাল মন্ডল মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী কৌশল্যার কাছ থেকে দানপত্র মূলে কমল মন্ডলের ছেলে ভারতীয় নাগরিক তাপস মন্ডল লিখে দিয়েছে মর্মে দুই বিঘা জমি দাবি করে সামাদ গাজী ও তার ছেলে আলমগীর কবীর। তাদেরকে অবগতি না করে ওই জমি আলমগীর কবীরের নামে নামপত্তন করা হলে তিনি তা বাতিলের জন্য ১৫০ ধারায় পিটিশন করেন। যাহা বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর আদালতে বিচারাধীন। ওই জমিসহ মোট তিন বিঘা অর্পিত সম্পত্তি ট্রাইব্যুনাল থেকে রায় ও ডিক্রী পেয়ে অবমুক্তির জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন তারা (সুনীল)। জেলা প্রশাসকের আদালতে বিচারাধীন জমিতে গত ১৭ আগষ্ট থেকে ২৮ আগষ্ট পর্যন্ত সামাদ গাজী ও তার ছেলে আলমগীর কবীর ৪০/৫০ জন ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী নিয়ে ফলজ ও বনজ গাছগাছালি কেটে ফল ও সবজি মিলিয়ে তিন লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুটপাট করে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে নেয়।

২৮ আগষ্ট অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ওই জমিতে স্থিতাবস্থা জারির নির্দেশ দেন। এরপরও ১৯ নভেম্বর তার স্বামী সুনীল মন্ডল মারা যাওয়ার পর ১১ ও ১২ ডিসেম্বর কাঁটাতারের বেড়া ও ইটের প্রাচীর দিয়ে তাদেরকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। ১১ ডিসম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে পুলিশ না আসায় ১২ ডিসেম্বর দুপুর একটার দিকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মঈনুল ইসলাম মঈন এর নির্দেশে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা মুকিত হাসান প্রতিপক্ষ সামাদ গাজীকে জবরদখল পক্রিয়া বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ১৪ ডিসেম্বর কালিগঞ্জ উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মঈনুদ্দিন খান ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করে আদালতের আদেশ অমান্য করে ও অবরুদ্ধ পরিস্থিতি দেখেও কোন ব্যবস্থা না নিয়ে চলে যান। তবে আর কোন কাজ না করার জন্য সতর্ক করেন সামাদ গাজীকে। আগামি ৭ জানুয়ারি রায় বিপক্ষে গেলে প্রাচীর ও কাঁটাতারের বেড়া সরিয়ে নেবে বলে আলমগীর কবীর ভূমি কমিশনারকে আশ্বস্ত করেন। এরপরও কাটা তারের বেড়ার উপর কাটা গাছের ডাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া ও আমগাছ স্প্রে করার বিষয়টি ভূমি কমিশনারকে অবহিত করলে তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরী করার পরামর্শ দিয়ে মোবাইল সংযোগ কেটে দেন।

১৩ ডিসেম্বর থেকে সামাদ গাজী ও তার লোকজন বিরোধপূর্ণ জমির পূর্ব পাশে তাদের প্রায় ৫ বিঘা জমিতে লাঙ্গল চাষসহ সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। হুমকি দিচ্ছে রাতের আঁধারে বাড়ি মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ায়। ১৯৮৯ সালে দুই ভাইপো, ১৯৯০ সালে আরো একভাইপোকে কুপিয়ে হত্যা ও নিহত তিন ভাইপোর এক ভাই রেজাউল করিমকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা মামলা, দীলিপ চক্রবর্তীর স্ত্রীকে ধর্ষণ, আবু সাঈদ ও তার মাকে চিরতরে লাপাত্তা করে দিয়েও তাকে কেউ কিছু করতে পারেনি বলে উদ্ধ্যত্য দেখিয়ে সামাদ গাজী প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছে যে, তোদের এ দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলে কোন সাক্ষী পাবি না। তার মেয়ের ভাসুর বিচারক তাই আদালতের যে কোন মামলার রায় তোদের পক্ষে নিতে পারবি না। এসব কথার সূত্র ধরে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন সুনীল মন্ডলের ছেলে শংকর মন্ডল, পুত্রবধু সরস্বতী মন্ডল, তাদের দুই শিশু সন্তান সন্দীপ মন্ডল (৬), সুদীপ মন্ডল (৪), সুনীল মন্ডলের মেয়ে চম্পা মন্ডল ও সুনীল মন্ডলের শ্যালক কানাই মন্ডল।

স্থানীয় বিএনপি নেতা ও ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি আলতাফ হোসেন বলেন, যেভাবে সুনীল মন্ডলের পরিবারের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে সামাদ গাজী ও তার ছেলে তা মেনে নেওয়া যায় না। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

আবুল হোসেন নামে এক গ্রামবাসি জানান, আওয়ামী লীগের এক সময়কার ইউনিয়ন সভাপতি ছিল সামাদ গাজীর মুক্তিযোদ্ধা ভাই। সে সময় আওয়ামী লীগ ভাঙিয়ে সব ধরণের সুবিধা নিয়েছে সামাদ গাজী।

চম্পাফুল ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোঃ সাইলু জানান, সামাদ গাজীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তার বাবাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়। যে কারণে সামাদ গাজীর বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।

সরেজমিনে ঘটনান্থল পরিদর্শনে যাওয়া প্রথম আলোর স্টাফ রিপোর্টার কল্যাণ ব্যাণার্জি, মানবাধিকার কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত, বাসদ নেতা নিত্যানন্দ সরকার, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের আশাশুনি শাখার সাধারণ সম্পাদক গোপাল মন্ডল, উপজেলা পুজা ফ্রন্টের সভাপতি পিংকাই বসু বলেন, ১৭ দিন ধরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়া সুনীল পরিবারের শৌচাগারে, রান্না ঘরে ও বসত ঘরে নারীদের অবস্থান করা সব ধরণের ছবি দূর থেকে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ধারণ করে প্রাইভেসী নষ্ট করে উপভোগ করছে আলমগীর কবীর ও সামাদ গাজী। অবিলম্বে ওই পরিবারকে অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্ত করে সকল সিসি ক্যামেরা সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তারা।

এ ব্যাপারে আলমগীর কবীর বলেন, সুনীল মন্ডলের ৪১ শতওেকর বেশি জমি নেই। অথচ আট বিঘার বেশি জমি দখল করছে। তাই কেনা জমির মালিক হিসেবে তারা দখলে নিয়েছেন।

এ ব্যাপারে সহকারি কমিশনার (ভূমি) মঈনুদ্দিন খান বলেন, অবরুদ্ধ করে ফেলার বিষয়টি অমানবিক। কবে ৭ জানুয়ারি রায় সুনীল মন্ডলের পক্ষে গেলে আলমগীর কবীর প্রাচীর ও বেড়া সরিয়ে নেবেন বলে তাক আশ্বস্ত করেছেন। তাদেরকে নতুন কোন কাজ করতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও তারা না মানলে মাধবী মন্ডলকে থানায় জিডি করার পরামর্শ দিয়েছেন।

সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মঈনুল ইসলাম মঈন বলেন, ধার্য দিনে অভিযোগের শুনানী করা হবে।

(আরকে/এসপি/ডিসেম্বর ২৭, ২০২৫)