ঢাকা, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত

ভাঙ্গনের খেলায় মধুমতির গর্ভে  ৪০টি গ্রাম

২০১৫ অক্টোবর ৩০ ১৪:৩৯:৫৭
ভাঙ্গনের খেলায় মধুমতির গর্ভে  ৪০টি গ্রাম

লোহাগড়া (নড়াইল) প্রতিনিধি : “এইহ্যানে আমার ভিটা ছেলো,ঐযে যেহানে কাঠি ভাসতিছে ওর পাশে ছিলো গোয়ালঘরডা, আমাগে রান্নাঘর ছিলো ঠিক তার পূবের পাশে,আর আমার ৩ ছাওয়ালের ভিটা ছেলো ওই পাকের ঠিক মাঝখানে”-বলতে বলতে ছেঁড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছেন মাঝ বয়সী শাফিয়া বেগম। বয়স ৫৫/৫৬ হবে। নদী তার সর্বস্ব কেঁড়ে নিয়ে বয়স বাড়িয়ে বৃদ্ধায় পরিনত করেছে।

এখন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সারাদিন কি যেন খুঁজতে থাকেন, আর বিড় বিড় করেন। স্বামী ইঞ্জিল মোল্যা ক্ষেতমজুর, পরের জমিতে কামলা দিয়ে দিন চলে তাদের। ২ মেয়ের বিয়ে আগেই দিয়েছেন ছেলেরা মধুমতির অন্যপাড়ে গোপালগঞ্জ আর ফরিদপুরে পাড়ি জমিয়েছে বেঁচে থাকার তাগিদে। টাকার অভাবে নিজের ভাঙ্গা ঘরের চাল আর খুটিগুলো নদীপাড়ে পড়ে আছে,তা দিয়ে কোথায় ঘর তুলবেন তা জানেন না শাফিয়া, এর ওর বাড়ি রাত কাটায় আবার কখনো মধ্য রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে মধুমতির পাড়ে এসে খুঁজে বেড়ান নিজের সেই বসত ভিটা আর শোবার ঘর। রাতে তার ঘুম আসেনা গবাদি পশু আর হাস-মুরগীগুলো না দেখতে পেয়ে, এইতো গত ৩ মাস আগেই তার ঘরবাড়ি বসতভিটা সব গিলে খেয়েছে মধুমতি নদী। ২টি হালের গরু আর ১টি দুধেল গাই বিক্রি করে দিয়েছেন পানির দামে,নিজেদের থাকার জায়গা নেই তো পশু দিয়ে কি হবে। সারাদিনে আজ আর কোন কাজ নেই সংসার হরানো এই নারীর। অথচ কতকিছু ছিলো একসময়। বলতে বলতে হারিয়ে যান তার যৌবনের কালে। অল্পবয়সে বৌ হয়ে আসেন ঘাঘা গ্রামে। শ্বশুরের ৪ ছেলের একসাথে বিশাল বাড়ি ছিলো তাদের। একসাথে চাষাবাদ আর গোলায় ধান উঠতো, ধানের সময় এলে ৪ বৌ আর পাশের বাড়ির লোকেরা মিলে একসাথে কাজ করতো। বাড়ির কাজ সেরে আধা মাইল দুরে নদীতে পানি আনতে আর গোসল করতে যেতেন সবাই মিলে। দিনের একমাত্র বিশ্রামের জায়গা ছিলো নদীর ঘাট,কত আপন ছিলো তখন এই মধুমতি নদী,নদীর পানিতে বাড়ির কাজ আর সেচ দিয়ে ফসল ফলানো হতো। “এই গাঙ ই যে আমাগের সব খেয়ে ফেলবে তাকি কেউ জানতো রে বাবা”। আর কোন কথা বের হয় না তার মুখ থেকে।

নড়াইলের লোহাগড়ার মধুমতি নদীর পশ্চিমপাড়ের দক্ষিনে ঘাঘা গ্রাম,দশবছর আগে থেকে এই গ্রামে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। এই ক বছরে মধুমতি নদী কেড়ে নিয়েছে ৩০ বছরের পুরানো ঘাঘা বাজার, বাজরের ২টি বড় চান্দি, ৫টি রাইসমিল আর শ’খানেক দোকানঘর।

নদীপাড়ের ১২ টি গ্রামের এই জমজমাট বাজারে একটি বড় মুদি দোকান ছিলো কামরুল বিশ্বাসের । দিনে আর রাতে মিলে তার দৈনিক আয় ছিলো প্রায় হাজার খানেক টাকা। এই আয় দিয়ে সে ৫ ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখেই সংসার করছিলো। কিন্তু এক বছর আগের ভাঙ্গনে তার সেই দোকানঘর সমেত সব চলে যায় নদীর পেটে। একরাতে ভাঙ্গনের আতঙ্কে যখন বাজারের নদীর পাড়ে প্রায় সব খেয়ে ফেলেছে নদী তখনও তার দোকান থেকে অন্ততঃ ২’শ গজ দূরে। বিপদে পড়লেন কখন কি হবে কি করে ব্যবসা করে খাবেন। এই ভেবে রাতে তার বাড়িতে ঘুম আসছিলো না,সেই রাতে শুরু হলো তুমুল বর্ষা সেই বর্ষারাতেই তার দোকান ভেঙ্গে নিয়ে যায় রাক্ষুসী মধুমতি, ভোরে গিয়ে তিনি দেখেন তার সবই শেষ।

মধুমতি নদীর পাড়ে ঘাঘা পশ্চিমপাড়ায় বাড়ি ছিলো কবির মোল্যার,বাপের রেখে যাওয়া জমিতে চাষাবাদ করে ৪ মেয়ে ৩ ছেলে নিয়ে অভাবেই চলছিলো তার সংসার। তবুও নিজের ভিটায় থাকেন,কোন রকমে খেয়েপরে।গত ৩ বছর ধরে আস্তে আস্তে মধুমতির কবলে চলে যায় তার জমি,পরে অন্যের জমিতে চাষ করে ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনরকমে বসবাস করছিলেন কবির মোল্যা,স্ত্রী পরের বাড়িতে কাজ করে ছেলে মেয়েদের খাওয়ায়। এতবড় সংসার চালাতে হিমশিম খেলেও রাতে নিজের বাড়িতে ঘুমাতেন এই ছিলো তাদের শান্তনা। কিন্তু মাস খানেক আগে নদী ভাঙ্গনে তার সেই ভিটেটুকুও চলে গেছে মধুমতির পেটে। তার ভাঙ্গা ঘরের চাল আর বেড়া খুলে আনা গেলেও ঘর বাঁধার আর কোন জায়গাই যে নেই তার ৩ বার মধুমতির ভাঙ্গনে সরতে সরতে তার পরিবারের আর কোন জায়গা অবশিষ্ট নেই। বাধ্য হয়ে ঘাঘা গ্রামের কবরস্থানের পাশের একটু খালি জায়গায় তার ভাঙ্গা চাল আর পাটকাঠির বেড়ার ঘরে সেখানেই সংসার পেতেছেন। রাতে শেয়ালের ডাকে ছোট ছেলেমেয়েদের ভয় লাগলে ও তার যে আর কোন উপায় নেই। কষ্টের কথা আর কাকে বলবেন,এই পাড়ের সব মানুষই ভাঙ্গনের আতঙ্কে দিন কাটান গ্রামের মাতবর আর ভদ্রলোকেরা সাহায্য করেনা? এই প্রশ্নের উত্তরে বৃদ্ধ কবির মোল্যা বললেন,‘ আমাগের এই ভাঙ্গন আল্লাছাড়া কেউ দ্যাহে না, তাই গোরস্থানে থাকি,আল্লা ডাক দিলেই চলে যাব। রাতদিন রাক্ষুসে নদীকে গালি দিয়েই স্বস্তি হয় তার।

প্রায় ৩০ বছর আগে গড়ে উঠা ঘাঘা বাজার, বাজারের পাশে স্কুল,একটু দুরে নদী পাড়ে দেড়শ বছরের পুরাতন বটগাছ। হাট বাজার শেষে হাঁটুরে লোকেরা বসতেন সেই বটের ছায়ায়। গ্রামে বৈশাখী উৎসব আর শীতকালে এই বটগাছ কেন্দ্র করে বসতো জারি আর কবি গানের আসর। মাঝে মধ্যে ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিল বসতো আর রাতভর চলতো ওয়াজ। ওয়াজকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন মেলা বসতো। সেসবই এখন স্মৃতি।

মধুমতি নদীর অব্যহত ভাঙ্গনে দক্ষিণ-পশ্চিমপাড়ের ঘাঘা, যোগিয়া, পাচুড়িয়া, পাংখারচর, লংকারচর, পাঁচুড়িয়া, কুমোরডাঙ্গা, তেলকাড়া, ধলইতলা, কোটাকোল, রায়পাশা, করগাতি, টি করগাতি গ্রামের একই দশা।

প্রতিবছরই বর্ষা মওসুমে মধুমতি নদীতীর সংলগ্ন লোহাগড়া উপজেলার শিয়েরবর, মাকড়াইল, মঙ্গলহাটা, মহাজন, শালনগর, ধানাইড়, বকজুড়ি, রামকান্তপুর, আমডাঙ্গা, বারইপাড়া এলাকা ভাঙ্গনের মুখে পড়ে নদীগর্ভে চলে যায় বাড়িঘর, গাছপালা বাজার সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শত শত একর ফসলি জমি। বর্ষা মৌসুমের পরে আরেক দফা ভাঙ্গছে মধঘুমতি নদী। বর্তমানে ভাঙ্গনের নেশায় পাগল প্রায় এই নদীর করালগ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে শত শত মানুষের সাজানো সংসার।

মধুমতির এই ভাঙ্গনের খেলায় পরাজিত হয়ে একমাত্র মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছেন মহিষাপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শেখ কিউবার হোসেন। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সাত শতক জমির ওপর মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিল তার। এখন সব হারিয়ে ৬ সন্তান সহ আট সদস্যের পরিবার নিয়ে তিনি নদীপাড়ে ছাপড়া তুলে বসবাস করছেন। অভাবের সংসারে নতুন করে ভাঙ্গনের যন্ত্রনায় তিনি একবারে অসহায় হয়ে পড়েছেন।
৮৫ বছরের জোহরা বেগম,স্বামী হারিয়েছেন বহু আগে। সন্তানেরা তার কোন খোঁজ রাখে না। এ পর্যন্ত ৫ বার মধুমতি নদী তার স্বামীর ঘর ভেঙ্গে ফেলেছে। সর্বশেষ গত মাস খানেক আগে এক রাতে তার শেষ সম্বল আশ্রয়টুকু ও ভাঙ্গনে চলে গেছে। এখন এবাড়ি ওবাড়ি থেকে পরের বাড়ি খেয়ে তার দিন চলছে।

এ রকম ভাবে গত ১’শ বছর ধরে চলা ভাঙ্গনে নদী এলাকার মহিষাপাড়া,পার মহিষাপাড়া,চর করফা,মঙ্গলহাটা,আতষপাড়া,চরকরফা গ্রামের অর্ধেকের বেশী অংশ চলে গেছে মদুমতির গর্ভে আর এসব এলাকার প্রায় ৫০ হাজার লোক প্রতিনিয়ত ভাঙ্গন আতঙ্কে দিন কাটায় ।

একই ভাবে ৫০ বছর ধরে ভাঙ্গনে বিলিন হয়ে গেছে মধুমতি নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ আমলের শিয়েরবর বাজার । গত বছরের তীব্র ভাঙ্গনে নদী পাড়ের বাজারের ৩ টি চান্দি, অন্তত ৩৫ টি দোকান আর শতাধিক বসতবাড়ি সহ একটি রেষ্ট হাউস ,পাঠাগার আর মসজিদ চলে গেছে মধুমতির পেটে । এলাকার শিশুদের জন্য একমাত্র সরকারি প্রাইমারী স্কুলটি ও মধুমতি নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে ।

মধুমতি নদীর শিয়েরবর অংশে এ বছর তীব্র ভাঙ্গন প্রবন অন্ততঃ ১ কিলোমিটার এলাকার নারায়ন চৌধুরী, কার্তিক চৌধুরী, বাসুদেব চৌধুরী, কুতুব মোল্যা, আতিয়ার শেখ ,তারা আলী, আতর আলী সহ অন্ততঃ ১শ টি পরিবারের বসত ভিটা বিলীন হয়ে গেছে । ভাঙ্গন আতঙ্কে পরিবার গুলোর লোকেরা দিনরাত কাজ করছেন শেষ সম্বল টুকু বাচানোর জন্য । আর আশ্রয় খুজছেন নতুন ভাবে বাচার জন্য । বছরের পর বছর ধরে নদী ভাঙ্গনের মধ্যে বাস করা এ সব মানুষেরা এবারের ভাঙ্গনের পরে আর নতুন কোন জায়গা খুজে না পেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো আশ্রয় খুজছেন।

ভাঙ্গনের প্রসঙ্গে কথা বলেন এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান বি এম হেমায়েত হোসেন হিমু বলেন,ভাই এবারের ভাঙ্গনের সময় আমাদের এমপি কে ডেকেছিলাম তিনি নদী পাড়ে থেকেই পানিউন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে ফোনে কথা বলেছেন,আমার নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে ১ হাজার জিও ব্যাগ ফেলেছি তার ও কোন টাকা পয়সা দেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড,তাদের কোন খেয়ালই নেই এদিকে।

নদীপাড়ের বাসিন্দা ব্যবসায়ী লিকু বলেন,এই ভাঙ্গনের ব্যাপারে নদীর পাড় বাধার জন্য এমপি,ডিসি,পানিউন্নয়ন বোর্ড সবখানেই দরখাস্ত দিয়েছি,কোথাও থেকে কোন সাড়া পাচ্ছিনা এলাকার লোকদের অবস্থা তো আপনারা দেখলেন এদের দেখার জন্য কেউ আসেনি, কেউ সামান্য সাহায্য পর্যন্ত করেনি।

নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য. শেখ হাফিজুর রহমান ভাঙ্গল কবলিত এলাকার মানুষের সাহায্যের ব্যাপারে বলেন,ভাঙ্গল কবলিত এলাকার মানুষের সাহায্যের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক বা সরকারী কর্মকর্তারা রিলিফ বা অন্য সাহায্য করতে পারে।এ ব্যাপারে এমপিদের করার কিছুই থাকে না। আমি ভাঙ্গন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে কথা বলেছি,পানি সম্পদ মন্ত্রীর সাথেও কথা বলেছি, তবে তাদের কাছ থেকে ভালো কোন আশ্বাস পাইনি।

নড়াইলের জেলা প্রশাসক মোঃ হেলার মাহমুদ শরীফ বলেন, মধুমতি নদীর ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষের সমস্যার ব্যাপারে আমাকে কেউ জানায়নি,এ ব্যাপারে তথ্য নিয়ে নদী ভাঙ্গন কবলিত মানুষের সাহায্যার্থে যা কিছু করনীয় তার সবই করা হবে।
ভাঙ্গন কবলিত মধুমতি পাড়ের ঘাঘা এলাকার ব্যাপারে কোন আশার কথা শোনাতে পারেননি নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন,আপাতত ঘাঘা-মহিষাপাড়া এলাকার মধুমতির ভাঙ্গনের ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তেমন কিছুই করনীয় নেই,তবে আমরা মধুমতি নদীর ঐ অংশ বরাবর মাগুরা পর্যন্ত নদীতীর বাঁধের জন্য প্রকল্প প্রনয়ন করেছি,তা পাশ হলে আশাকরি আর ভাঙ্গন থাকবে না।

নদীপাড়ের ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষের দাবি, ভাঙ্গনের কবলে থাকা মানুষের জন্য সরকারীভাবে জরুরী উদ্যোগ গ্রহন করা হোক । তা না হলে নদী ভাঙ্গনের ফলে এখানে আরো কিছু উদ্বাস্তু সংখ্যা বাড়বে।

(আরএম/এএস/অক্টোবর ৩০, ২০১৫)