ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » বিশেষ খবর » বিস্তারিত

সেদিন খুনি মোশতাককে স্বাগত জানিয়েছিলেন আজকের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী

২০১৬ জুলাই ১৫ ০০:৪৫:৫৯
সেদিন খুনি মোশতাককে স্বাগত জানিয়েছিলেন আজকের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী

[পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনি মোশতাককে স্বাগত জানিয়েছিলেন আজকের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন। ওই সময়ে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে 'প্রসঙ্গ : দেশ ও জাতি' শিরোনামে একটি উপসম্পাদকীয় কলাম লেখেন। সেই কলামেই তিনি মোশতাক ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত সেনাদের স্বাগত জানান। আনোয়ার হোসেনের সেই লেখাটি উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের পাঠকদের জন্য আবার প্রকাশ করা হলো]


কয়েকদিন ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগিয়া উঠিয়াছি। শরীর এখনো দুর্বল। বর্তমান সরকার দৈনিক ইত্তেফাক আমাদের হাতে ফিরাইয়া দিয়াছেন,ইহাতে পুনরায় নিজেদের ব্যবস্থাপনায় চালু করিতে গিয়া গত কয়েকদিন আমাদের সকলকে ব্যস্ত থাকিতে হইয়াছে। শারিরীক এই দুর্বলতা ও ব্যস্ততা সত্বেও দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বক্তব্য পাঠক সাধারণের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন বোধ করিতেছি।

প্রথমেই বলিতে হয়, দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা। এই পরিবর্তন আকস্মিক, তবে অস্বাভাবিক নয়। প্রকৃতির যে নিয়ম, সেই নিয়মের বাইরে কেউ যাইতে পারে না।নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে যদি রুদ্ধ করিয়া দেওয়া হয়,তবে নদীর জলরাশি অস্বাভাবিক উপায়ে হইলেও উহার গতিপথ সৃষ্টি করিয়া নিবে।ইহাই প্রকৃতিদত্ত নিয়ম। পৃথিবীতে এই নিয়মের ব্যত্যয় কখনো ঘটে নাই, ঘটিতেও পারে না। বাংলাদেশে মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলের নাম করিয়া যে ব্যবস্থাটি দাঁড় করানো হইতেছিল, আপামর দেশবাসীর মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে গোটা ব্যবস্থাটি সেখানে মুষ্টিমেয় দ্বারা কুক্ষিগত করা হইয়াছিল, বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল গণ মানুষের নিয়মতান্ত্রিক আত্মপ্রকাশের পথ। এই সর্বগ্রাসী ব্যবস্থার দ্বারা মানুষ নিষ্পেষিত হইতেছিল, ভাঙ্গা বুকের যাতনা ও হতাশা তীব্র হইতে তীব্রতর হইতেছিল। এর যে কোথায় শেষ, কেহ ভাবিয়া পাইতেছিল না। এই অবস্থায় প্রকৃতির নিয়মেই একটা পথ সৃষ্টি হইয়াছে। বলা যায়, মুষ্টিমেয় কিছু লোকের দ্বারা কুক্ষিগত সেই সর্বগ্রাসী ব্যবস্থার ফলেই বর্তমানের রাজনৈতিক পরিবর্তনটি দেশের সর্বাত্মক পরিস্থিতির দুঃসহ অবস্থায় অবধারিত হইয়া উঠিয়াছিল।

এই নতুন রাজনৈতিক পরিবর্তনটি সাধিত হইয়াছে প্রবীন রাজনৈতিক নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে, সেনাবাহিনীর দ্বারা।এই পরিবর্তন সাধনে তরুণ সামরিক অফিসারদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বলা যায়,দেশের একটা অসম্ভব দুঃসহ অবস্থার বিলোপ ঘটাইয়াছেন তাঁরা এবং জাতির সামনে সৃষ্টি করিয়াছেন চলার উপযোগী পথ ও সুযোগ। এই কাজের জন্য তাঁরা গোটা জাতিরই অভিনন্দন লাভের যোগ্য। গোটা জাতি যে সময় দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় শুধু নিচের দিকে তলাইয়া যাইতেছিল, সেই সময় তাঁরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়া এই পরিবর্তন সাধন করিয়াছেন। ব্যক্তি পর্যায়ে কাহারও জন্য দুঃখ-শোক বা সহানুভূতি প্রকাশের চাইতেও জাতীয় স্বার্থের দিকটা বড় করিয়া দেখার দেখার যে আবশ্যকতা, সেই বিবেচনায় এই নতুন রাজনৈতিক পরিবর্তনকে স্বাগত জানাইতে হইবে।

তবে রাজনৈতিক পরিবর্তনের যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস তাহা সাময়িক। সাধারণ মানুষকে যখন রূঢ় বাস্তবের মোকাবেলা করিতে হয়, ভাত কাপড়ের সমস্যায় পড়িয়া দিশাহারা হইতে হয়, তখন রাজনৈতিক পরিবর্তনের আনন্দ-উচ্ছ্বাস মিলাইয়া যায়। অতএব, রাজনৈতিক পরিবর্তনের এই সূচনাকে গণ-মানুষের অর্থনৈতিক ভাগ্যন্নয়ন ও স্বাচ্ছন্দ্যবিধানের কাজে রূপায়িত করিতে হইবে। এই কথা মনে রাখা দরকার , সূচনাতে কোন কিছুরই শেষ নয়, শেষ উহার পরিণতি ও ফলাফলে। একটি ঐতিহাসিক সূচনা যাহাতে উহার সমস্ত সম্ভাবনা লইয়া সাধারণ মানুষের জীবনে বাস্তবায়িত হয় তাহা সর্ব প্রথমে নিশ্চিত করিতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে বিগত সাড়ে তিন বছরের সময়কালের ভিতর নানারকমের মতবাদ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু করিতে গিয়া দেশের পঙ্গু অর্থনীতিকে একেবারেই শয্যাশায়ী করিয়া ফেলা হইয়াছে।দেশের সীমিত সম্পদ, পুঁজি ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ তৎপরতাকে ব্যবহার না করিয়া চালানো হইতেছিল এমন সব মারাত্মক পরীক্ষা-নিরীক্ষা যার জন্য দেশের মানুষকে দিতে হইয়াছে বহু মূল্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দেশের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্প-কারখানাগুলিকে দেশের সম্পদ বৃদ্ধির কাজে লাগানো হয় নাই। অর্থনীতির অনুৎপাদনশীল প্রবণতা থাকা সত্বেও মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এইগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হইয়াছে, ভর্তুকি দিয়া অ-লাভজনক ও দায়স্বরূপ করিয়া তোলা হইয়াছে। জনগণের টাকা দিয়া এই সকল রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কল-কারখানাকে চালানো হইতেছিল এবং ইহার ফল দাঁড়াইয়াছিল একটাই এবং তাহা এই যে, কোন কোন ক্ষেত্রে উহা মুষ্টিমেয় কিছু লোকের লুটপাটের স্থায়ী সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হইয়াছিল। এই ব্যবস্থায় সামগ্রিক দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা হইয়াছে দুঃসহ। দেশ দিনকে দিন শুধু বাহিরের ভিক্ষা ও কৃপার উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িয়াছিল। এরূপ অবস্থায় কোন দেশ, কোন জাতিই টিকিয়া থাকিতে পারে না। পারে না বিশ্বে মর্যাদার স্থান প্রতিষ্ঠা করিতে।

এই সকল বিষয়ে প্রেসিডেন্ট তাঁহার জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত প্রথম ভাষণে যে মত ও বক্তব্য রাখিয়াছেন, তার সাথে আমরা একমত। প্রচলিত মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোন জাতিরই প্রাণস্পন্দন ঘটিতে পারে না। নাগরিক অধিকারবোধ ছাড়া আসিতে পারে না কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। দেশের অভ্যন্তরীন পুঁজি গঠন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রচলিত মূল্যবোধ ও নাগরিক অধিকারবোধ নিশ্চিত ফলপ্রসূ অবদান রাখিতে পারে।

আর একটা প্রসঙ্গে কিছু বলিয়াই আমার আজিকার বক্তব্যের ইতি টানিব। প্রসঙ্গটি বিদেশী সাংবাদিকদের কলমে বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে কি লেখা হইবে সেই চিন্তা সামনে রাখিয়া কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আদৌ প্রয়োজন আছে বলিয়া আমি মনে করি না।সাংবাদিক দেশীই হউন, বিদেশী হউন, তাহাদের সংবাদ ও তথ্য সংগ্রহের সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হউক, যাহাতে ভুল তথ্য পরিবেশনের কোন অবকাশ না থাকে। কতৃপক্ষ এইরূপ ব্যবস্থা নিলে কোন বিষয়ে ফিসফিস গুঞ্জনের কোন কারণ ঘটিবে না। সরকার বিদেশী সাংবাদিকদের ৭২ ঘণ্টা অবস্থানের সুযোগ দিয়া বস্তুতপক্ষে দূরদর্শিতার কাজই করিয়াছেন, তবে সময়সীমা নির্ধারণ না করিয়া তাঁহাদের অবাধ বিচরণের সুযোগ দিলে ব্যক্তিগতভাবে আমি আরও খুশী হইতাম। আমার ধারণা মতে, সাংবাদিকদের অবাধে সংবাদ গ্রহণের সুযোগ দেওয়াই উচিত। বিদেশী সাংবাদিকদের বেলায় বিধি-নিষেধ বা সেন্সরশীপ আদৌ প্রয়োজন নাই। তাঁহারা বাংলাদেশের অবস্থা ভাল করিয়া দেখুন, দেখিয়া লিখুন। দুনিয়া বাংলাদেশের উপর সব সময়ই সহানুভূতিশীল ছিল, এই ক্ষেত্রেও বিদেশী সাংবাদিকদের নিকট সেই সহানুভূতি আশা করা ভুল হইবে না। বিধি-নিষেধ ও সেন্সরশীপের দরুন ভুল বুঝাবুঝির আশঙ্কা ইতিপূর্বে বহুবার দেখা দিয়াছে। দেশের ভিতর বিদেশী সাংবাদিকদের আসিতে দেওয়া না হইলেও তাঁহাদের সুযোগ-সুবিধামত যে কোন স্থানে বসিয়া বাংলাদেশের অবস্থার উপর রিপোর্টিং হইতে পারে। আমাদের প্রেসিডেন্ট বরাবরই সৎ সাংবাদিকতার উপর শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাবান। এবং নীতিগতভাবে স্বাধীন সংবাদপত্রে বিশ্বাসী। সুতরাং এই ক্ষেত্রেও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কোন অবকাশ থাকিতে পারে না। অতীত অভিজ্ঞতার প্রতিটি বিন্দুকে কাজে লাগানোর চিন্তা করিতে হইবে।সত্য বতে,অনেক সময় নাজুক অবস্থা বিরাজ করে। তখন মনে হইতে পারে কোনরকম অবাঞ্ছনীয় বা বিরূপ মন্তব্য অবস্থাকে আরও নাজুক করিয়া তুলিতে পারে। ইহার সবই সত্য। কিন্তু সৎ সাংবাদিকের কলমের উপর আস্থা রাখাই শ্রেয়। এই ক্ষেত্রে কোন দ্বিধা বা সংশয় সাংবাদিকের কলমের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করিতে পারে। আনিয়া দিতে পারে সহানুভূতির বদলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলাফল। বিদেশী সাংবাদিকরা বাংলাদেশকে বুদ্ধি ও হৃদয় দিয়া অনুভব করিলে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকারণের সূত্রে সমুদয় পরিস্থিতিকে যাচাই ও বিচার-বিশ্লেষণ করিলে ইহাতে আমাদের উপকার ছাড়া অপকার হইবে না, এই বিশ্বাস আমাদের আছে।

এই বিশ্বাসও আমাদের আছে যে, বাঙ্গালী জাতি সব পর্যায়ে নিজেদের ভাগ্যন্নয়নের একটা সুযোগ লাভ করিয়াছে। জাতিকে এখন সংহতি ও একতার দিকে পরিচালিত করিতে হইবে। স্মরণ রাখিতে হইবে এই রূঢ় বাস্তবতা যে, জাতিকে সুপরিকল্পিতভাবে টুকরা টুকরা করার চেষ্টা চলিতেছিল। নব পর্যায়ে দূর করিতে হইবে এই অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা। অবিশ্বাসের দৃষ্টিকে পরিহার করিয়া সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের সুরকে ঐক্যবদ্ধ করিতে হইবে। দেশের মানুষের মনে স্বস্তি ও শান্তির ভাব ফিরাইয়া আনার যে সূচনা করা হইয়াছে, উহা সফল ও স্থায়ী হউক, এই প্রত্যাশাই করিতেছি।

(পিএস/অ/জুলাই ১৫, ২০১৬)