প্রচ্ছদ » বিশেষ খবর » বিস্তারিত
জীবজগতে যে পুরুষ গর্ভ ধারন ও সন্তান প্রসব করে
২০১৭ ফেব্রুয়ারি ০৬ ১২:৩১:৪২নিউজ ডেস্ক :অনেকের কাছেই বিষ্ময়কর মনে হলেও পৃথিবীতে এমন একটি প্রাণী আছে যে প্রাণীটির পুরুষ সংগীটি তার দেহে নারী সংগীর ডিম ধারন করে,নিষিক্ত ডিম নিজের দেহে বহন করে এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে বাচ্চা দেয়। বিচিত্র এই প্রাণীটির নাম Seahorse বা সামুদ্রিক ঘোড়া। সাধারনভাবে আমরা ঘোড়া মাছ নামে ডেকে থাকি।
এরা সাধারনত লম্বায় প্রায় ১.৫সে. মি. থেকে ৩৫সে. মি. পর্যন্ত হয় । এদের দেহের সামনের ভাগ ঘোড়ার মত ও পেছনের দিকে বঁকানো লেজ আছে। সামুদ্রিক মৎস্য ভান্ডারের তালিকায় সীহর্স (Seahorse) নামে ৫৪ প্রজাতির ছোট আকৃতির সামুদ্রিক মাছের নাম দেওয়া হয়েছে। এই সাগর ঘোড়া বা সীহর্স নামের এই মাছ গুলো Hippocampus জেনাস ভুক্ত।
প্রাকৃতিক পরিবেশে এদের গড় আয়ু ১-৫ বছর। সীহর্স কডার্টা পর্বের অস্থিময় মাছ । তবে এদের দেহে কোন আঁইশ নেই । অস্থিময় পাতের ওপর পাতলা চামড়ার আবরণ রিং এর মতো সাড়া দেহে আবৃত। প্রতিটি প্রজাতির দেহে রিং এর সংখ্যা আলাদা আলাদা। রিঁং এর সংখ্যা দেখে এদের প্রজাতি সনাক্ত করা যায়। এদের মাথায় মুকুটের(coronet) মতো । অবাক করা ব্যাপার হলো মাথার এই মুকুটটি একই প্রজাতির প্রত্যেকটি প্রাণীর জন্য আলাদা। এদের দেহে একটি মাত্র পৃষ্ঠীয় পাখনা রয়েছে। চলাচলের সময় পৃষ্ঠীয় পাখনায় প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩৫বার দুলিয়ে এরা খুব ধীরে রাজকীয় কায়দায় চলাচল করে। বাঁকানো লেজের সাহায্যে এরা প্রবাল প্রাচিরের সামুদ্রিক আগাছা ও শৈবালের সাথে আঁকড়ে থাকে।
প্রবাল প্রচীরের রঙিন পরিবেশের সাথে মানিয়ে গায়ের রঙ পরিবর্তন করে; কখনো কালচে-বাদামি, কখনো ধূসর বা উজ্জ্বল হলদে। এরা এদের চোখ আলাদা ভাবে নাড়তে পারে। সীহর্সের জেনাস হিপ্পোক্যাম্পাস (hippocampus) ।এই নামাকরন করা হয়েছে গ্রিক পুরান অনুসারে যেখানে”হিপ্পোস( hippos)” মানে ঘোড়া(horse), আর “ক্যাম্পোস(kampos)” মানে সমুদ্রের রাজা। সীহর্স আর তাদের নিকাত্মীয় সী ড্রাগন হলো বিশ্বের এমন এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রাণী যাদের পুরুষরাই গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করে।
প্রাপ্ত বয়স্ক সীহর্স প্রথমে সংগী বাছাই করে। সাগরের প্রবাল উদ্যানে একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী সাগর ঘোড়া পরষ্পরকে প্রাথমিক ভাবে পছন্দ হলে উভয়ে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা হতে কয়েকদিন পর্যন্ত বিবাহ পূর্ব ঘনিষ্ট প্রেমে আবদ্ধ হয়। বিজ্ঞানীরা সীহর্সের এই সমকালের courtship* নাম দিয়েছেন। সীহর্সের বিবাহ পূর্ব এই প্রেম চলাকালিন সময়ে তারা উভয়ে দেহের রং পরিবর্তন করে। পরষ্পরের লেজ আকড়িয়ে ধরে সাঁতার কাটে, পরষ্পরের দেহের ঘনিষ্ট সংষ্পর্শে থাকে। একটি শৈবাল শাখা পেছিয়ে দুজনে অবসর কাটায়। কখনো দুজন আনন্দে নৃত্য করে। যাকে বিজ্ঞানীরা “predawn dance” বলে থাকেন। কখনো কখনো এই যৌথ “true courtship dance” আট ঘন্টা ব্যপীও চলে। দীর্ঘ এই প্রেম পর্বে পরষ্পর সম্মত হলে এরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় । পরষ্পরকে আর ছেড়ে যায় না। পুরুষ সীহর্সের পেটে একটি থলি (pouch) রয়েছে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার সিদ্ধান্তের পর পুরুষটি তার পেটের থলিতে পানি দ্বারা পাম্প করে যাতে থলিটি খালি ও উন্মুক্ত হয়। উন্মুক্ত থলিটি পর্যবেক্ষণ করে স্ত্রী সীহর্স সন্তোষ্ট হলে স্ত্রী সীহর্স পুরুষটির দেহের পেটের দিকে অবস্থিত ঐ বিশেষ থলেতে ১৫০০- ২০০০ এর মতো ডিম পাড়ে ।
ডিম পাড়া শেষে দুজনেই প্রথমে শৈবাল বনে আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষন পর স্ত্রী অন্যত্র চলে যায় আর পুরুষটি নিজ দেহে রক্ষিত ডিমের যত্ন নিতে শৈবাল শাখায় গর্ভকালীন সময় কাটায় । এ সময়ে স্ত্রী মাছ প্রতিদিন সকালে একবার করে পুরুষ মাছটিকে দেখতে আসে ও সেবাযত্ন করে যায়। পুরুষটির দেহে ২-৪মাস গর্ভকালীন সময় শেষে ডিম থেকে বাচ্চা হয়। সব বাচ্চা একাকী বেঁচে থাকার মত সক্ষমতা অর্জন না করা পর্যন্ত বাচ্চারা পুরুষ মাছটির পেটেই থাকে। উপযুক্ত সময়ে পুরুষ সীহর্স পেটের থলিতে পানি দিয়ে পাম্প করতে করতে একটি দুইটি করে বাচ্চা প্রসব করে।এরা ৫০০- ১৫০০টি জীবন্ত বাচ্চা প্রসব করে। পুরুষরা মূলত রাতেই একাকী দীর্ঘ কষ্টকর সময় ধরে বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চা প্রসবের পর পুরুষটি আর কোন দায়িত্ব নেয় না। সকাল পর্যন্ত সংগীর প্রতিক্ষায় থাকে। প্রজনন মৌসুমে সন্তান প্রসবের পরবর্তী দিন সকালে যখন স্ত্রী মাছ তাকে দেখতে আসে। ২৪ ঘন্টা বিরতিতি দিয়ে তখন পুরুষটি নতুন করে ডিম গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকে। আবার দুজনে নাচানাচি করে শৈবাল বনে ঘুরে বেড়ায় । নবজাতকরা বনের আশেপাশে একাকী থাকে। ওদের কোন দায়িত্ব নেয় না। দুজনে ধীরে ধীরে দুজনের লেজ ধরাধরি করে সাঁতার কাটে। স্ত্রীটি খালি থলে দেখে। পুরুষটির গর্ভাসন্ঞ্চার হয় আবার । জলজ উদ্যান ছেড়ে তারা আমৃত্যু কেউ কাউকে ছেড়ে যায়না। আর বাচ্চারা জন্মের পরপরই স্বাধীন ভাবে জীবন যাপন করে। কিছুদিন পরেই একই নিয়মে সংগী বেছে নেয়। এই আশ্চর্য সুন্দর প্রাণীটির এই পর্যন্ত ৪৭ টি প্রজাতী সনাক্ত করা হয়েছে । তার মধ্য ১৪টি প্রজাতি গত শতাব্দীতেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।কৃতজ্ঞতা :বেলাল হায়দার পারেভজ
(ওএস/এস/ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৭)