ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » শিল্প-সাহিত্য » বিস্তারিত

ড. জাহিদা মেহেরুননেসা’র কবিতা

২০১৭ মার্চ ০৩ ১৭:৫৮:৩৮
ড. জাহিদা মেহেরুননেসা’র কবিতা







জন্মদিনে

পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে কত অনাদৃত জন্মদিন আসে
অসংখ্য ফুল ঝরে যায় কত অবহেলায়,
মানুষের কতটুকু মূল্য এই বিস্তীর্ণ সবুজ চরাচরে
কতটুকু মূল্য এই সৌরজাগতিক সংসারে ।
কত আশা নিয়ে দেখেছি সবুজ পৃথিবীর মুখ
সব শুধু আশার চকচকে মোড়কে বাঁধা
একের পরে আরেক সুদৃশ্য মোড়কের আবরণ
খুলেছি বৃথাই এতকাল-
মেলেনি আকাঙ্ক্ষিত সূর্যোদয়ের আশ্বাস
মুখ থুবড়ে পডেছে সময় অনেক কাল আগে,
ক্রমাগত চাপে পিষ্ট হতে হতে কেটেছে দিনের শ্রেষ্ঠ সময় ।
বন্দিত্বের যন্ত্রণা মেনেছি ভাতের কাছে,
সয়েছি অন্যায় অপমান যেন প্রাণপণে প্রাণটা বাঁচে।
দিনের পর দিন দেখেছি কারা যেন ঋদ্ধিমান দেহে ঘরে তোলে-
আমাদের অসহায় সন্তানের গলে যাওয়া মৃতদেহ,
নির্বিকারে সাজায় অহংকারী পিরামিড,
কারা যেন বাগানের বহুবর্ণের ফুল তুলে নিয়ে
রুচিবোধের প্রশংসা কুড়িয়ে নেয় প্রাণভরে।
ফুলের বেঁচে থাকার আহাজারি শোনে না কখনও তারা
প্রতিদিন কত অসংখ্য ফুলের আশাভঙ্গ হয়,
সেইসব কথা বাতাসের কানে কানে ঘুরে বেড়ায়
প্রতিটি জন্মদিন আসে মৃত্যুর বার্তা নিয়ে হাতে,
স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায় আরেকটি বছরের ব্যর্থতার ।
অথর্ব বৃদ্ধের কঙ্কালের মুখে কথা ফোটে,
কাজের শোরগোলে প্রশংসা কিনে নেয়।
তরুণেরা হাতে তালি দেয়,
মৃতদের পুনর্জন্ম দিতে দিতে
তাদের জীবন কেটে যায়।
অথচ তরুণেরা স্বপ্ন দেখতে জানে,
তরুণেরা ফসল আনতে পারে ঘরে,
তরুণেরা নতুন শিশু জন্ম দিতে পারে,
তরুণেরা তরুণীর বুকে ভালবাসার রঙে
স্বপ্নছবি এঁকে দিতে পারে দিনের পর দিন -
অথচ আমরা শুধু দেখে গেছি,
ভেসে গেছি শোরগোল নদীর কালস্রোতে ।
ভেবেছি কি কোনদিন
নদীর বিরুদ্ধ স্রোতে ঘাড় ঘুরিয়ে
আমারও কথা বলার অধিকার আছে ।
জন্মদিন পালন করেছি শুধু,
কেক কেটে কষ্টের সমুদ্র কেটেছি শুধু,
মগ্ন থেকেছি মিথ্যে মরীচিকায়
প্রতিরোধের আগুন দেখিনি আত্মরক্তস্রোতে
করতে পারিনি কিছুই,
ভেল্কিবাজি, জুয়ার আড্ডা, শুভংকরের ফাঁকি
টাকার বিনিময়ে আর কারো অধিকার বেচাকেনা ।
ক্ষমতা আর সন্ত্রাসের জয় জয়কারে চুপসে
গেছে জীবন-স্বপ্নের অধিকার ।
খলনায়ক আর খল মানুষের দৃপ্ত পদযাত্রা
ভাঁড়ামো রসিকতায় বিবমিষা বেড়েছে কেবলই।
পদ্মপাতার জলে ভালবাসা শিশিরের জল
হয়ে টলমল কাঁপে ।
তবুও পদ্মপুকুরে অসংখ্য পদ্ম ফোটে ।
লাল পদ্ম, নীল পদ্ম,
অজানা অচেনা রঙের রঙিন অসংখ্য পদ্ম ফোটে ।

দিনে দিনে দিন চলে গেল।
বায়ান্ন গেল, চুয়ান্ন গেল, গেল আরও কতগুলি বছর
চোখের সামনে বিভীষিকাময় পঁচিশে ফেব্রুয়ারি।
কত চেনা অচেনা মানুষের আহাজারি ।
সত্যি কি সব ভুলে যেতে পারি?

তারপর চলে গেল কত প্রিয়জন।
একে একে মিছিল বেঁধে সব চলে গেল।
রক্তাক্ত লাশ হয়ে চলে গেলেন দুঃসাহসী হুমায়ুন আজাদ
চলে গেলেন নিভৃত নির্বিঘ্ন নির্জন আবদুল মান্নান সৈয়দ ।
চলে গেলেন আরো কত প্রিয়জন।
নিঃসঙ্গ শেরপা শামসুর রাহমান।
যাঁদের একটি বাক্য শুনবার অপেক্ষায় থেকেছি প্রতিটি মুহূর্ত,
সেই সৈয়দ শামসুল হক আর নেই -
কথা শুনবার অদম্য আকাঙ্ক্ষা আর নেই ।
তারপরও জেগে থাকে আমাদের রাতদিন,
তারপরেও কত প্রিয়মুখ এসে গেঁথে যায় মনে
কী অদম্য অদ্ভুত টান বাংলা একাডেমি চত্বরে
এখন সব খাঁ খাঁ রোদ্দুর মাথার উপরে চিল ওড়ে
কারা যেন কীসের গন্ধ খোঁজে।
বদলে গেছে চিরতরে এর ভিত্তিভূমি
আকর্ষণের টানটি একেবারেই আলগা হয়ে গেছে
ঝুরঝুর করে ঝরে পড়েছে এর অস্তিত্বের মাটি
অসংখ্য মুক্তবুদ্ধি হত্যার মাস এই ফেব্রুয়ারি,
আমার ফেব্রুয়ারি
আমার রঙের ফাল্গুন
আমার সমস্ত সুন্দর
আমার ভালবাসার অনন্তধারা
আমার প্রেমের আনন্দ অশ্রুজল।
ফাল্গুনে কোকিলের কুহুতানে চোখ মেলে
মুগ্ধ শব্দে যখন হৃদয় জেগেছে শুধু,
এ বাতাস আমার চিরচেনা।
বাকি সব থেকে গেছে চির অজানা
তবু এখনো তো ভোরে
পাখিরা মুখর প্রেমের স্বপ্ন আঁকে ।
তারপরও প্রতিদিন অসংখ্য প্রিয়মুখ
জীবনকে রঙিন করে রাখে ।
থেকে যায় বুকের গভীরে অসম্ভব আলোকবর্তিকা,
সময়ের উজ্জ্বলতম কত নক্ষত্র লেখা
আমার বর্তমান, অতীত, আমার ভবিষ্যৎ ।